শনিবার, ১৫ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

এক যুগেও হয়নি বিচারপতি নিয়োগে আইন

আরাফাত মুন্না

সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও স্বাধীনতার ৫২ বছরেও তৈরি হয়নি উচ্চ আদালতে বিচারক (বিচারপতি) নিয়োগ সংক্রান্ত আইন। বর্তমান সরকার ২০১২ সালে আইনটি প্রণয়নের প্রথম উদ্যোগ নেয়। তারপর কেটে গেছে প্রায় এক যুগ। এ সময়ে আইনটির খসড়া প্রণয়ন করা হলেও তা চূড়ান্ত হয়নি। বারবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও এখনো খসড়াই রয়ে গেছে।

আইনজ্ঞরা বলছেন, শক্তিশালী বিচার বিভাগ গড়ে তুলতে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। আইন প্রণয়ন না করে বিচারক নিয়োগের ফলে দীর্ঘদিন ধরে যে প্রশ্ন উঠছে, তা থেকেই যাবে। তারা বলেন, উচ্চ আদালতের একাধিক রায়েও বিচারপতি নিয়োগের আইন বা নীতিমালা করার কথা বলা হয়েছে। রায়ে উঠে এসেছে নানা পর্যবেক্ষণও। সংবিধানেও আইনের বিষয়ে বলা হয়েছে। তাই দ্রুত এই আইন করা জরুরি।

খসড়া আইনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আইনটি নিয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যেই আইনটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করতে পারব।

এদিকে বর্তমানে বিচারাধীন মামলার তুলনায় হাই কোর্টে বিচারক সংকট রয়েছে। এক সময় হাই কোর্ট বিভাগে বিচারকাজ পরিচালনা করতেন ১০২ বিচারপতি। এখন সেখানে রয়েছেন ৮৪ জন। এঁদের মধ্যে ৮১ জন বিচারিক কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। বাকি তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তাদের বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে।

উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাই কোর্ট বিভাগের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৪৭টি। সেই হিসাবে হাই কোর্টের প্রত্যেক বিচারপতির সামনে গড়ে ছয় হাজারের বেশি মামলা রয়েছে। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে অতি দ্রুত আইন বা নীতিমালা করাটা জরুরি বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি আইনমন্ত্রী (২০০৯-১৪) থাকার সময়ে বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালার চূড়ান্ত খসড়া করেছিলাম। এরপর কী হলো জানা নেই। তিনি বলেন, এই আইনটি করা হলে বিচার বিভাগ আরও শক্তিশালী হবে।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ আইনটি সাধারণ আইনজীবীদের দাবি। এটি কিন্তু আওয়ামী লীগের ওয়াদাও। বর্তমান আইনমন্ত্রীরও ওয়াদা ছিল যে, শিগগিরই আইনটি করা হবে। আইন ও নীতিমালা ছাড়া যদি বিচারপতি নিয়োগ করা হয়, তাহলে আমি মনে করি এটা সংবিধানের পরিপন্থি হবে। তিনি বলেন, আগামীতে উচ্চ আদালতে কোনো বিচারক নিয়োগ দেওয়ার আগেই আইনটি করা উচিত। এর ফলে বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা আসবে।

সংবিধানে যা আছে : বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ বিষয়ে বলা আছে। ৯৫(১) এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারপতিকে নিয়োগদান করবেন।’ ৯৫(২) এ বলা হয়েছে, ‘কোনও ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে এবং (ক) সুপ্রিম কোর্টে অন্যূন ১০ বছর অ্যাডভোকেট না হয়ে থাকলে, বা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন ১০ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে, অথবা (গ) সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে, তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।’

বিচারক নিয়োগ নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা : ২০০৯ সালের ২ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে বাদপড়া ১০ বিচারপতিকে স্থায়ী নিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই নির্দেশনায় বিচারপতি নিয়োগের আইন বা নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়। এ ছাড়া ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল হাই কোর্ট বিভাগ উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগে সাত দফা নির্দেশনা দেন। তৎকালীন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের (অবসর) হাই কোর্ট বেঞ্চ পর্যবেক্ষণও দেন।

সেই পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রধান বিচারপতিকেই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তাকে প্রয়োজনে বিচারক নিয়োগের জন্য আপিল বিভাগ ও হাই কোর্ট বিভাগের দুজন করে জ্যেষ্ঠ বিচারপতির পরামর্শ নিতে হবে। তবে বিচারপতি নিয়োগে প্রধান বিচারপতি যে মতামত দেবেন, তা অগ্রাহ্য করা যাবে না, যদি না সুপারিশকৃত ব্যক্তি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে সম্পৃক্ত থাকেন। ভারতের আইন কমিশনের ৮০তম প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী একজন বিচারকের পরিপক্বতা পেশাগত অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে একটি বয়সসীমা ধরা হয়েছে। সেই হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক মনোনয়নের ক্ষেত্রে বয়স সর্বনিম্ন ৪৫ বছর হওয়া উচিত বলেও পর্যবেক্ষণ দেয় হাই কোর্ট বিভাগ।

সর্বশেষ খবর