শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

পানিবন্দিদের সীমাহীন দুর্ভোগ

সিলেটে বন্যার অবনতি ♦ সারা দেশে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত ♦ খাবার সংকট ♦ তলিয়েছে সড়ক ও ফসল ♦ ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ♦ বেড়েছে নদীভাঙন ♦ মৌলভীবাজারে দুই মৃত্যু

প্রতিদিন ডেস্ক

পানিবন্দিদের সীমাহীন দুর্ভোগ

বন্যায় তলিয়ে গেছে সিলেটের উপশহর এলাকার সড়ক -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বৃষ্টিপাত কমলেও এখনো বিপৎসীমার ওপরে বন্যার পানি। ঘরবন্দি হয়ে আছেন লাখ লাখ মানুষ। সিলেট, রংপুর, গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। খাবার সংকটে এরই মধ্যে অনেকে পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। অনেক স্থানেই তলিয়ে গেছে সড়ক ও ফসলি মাঠ। ভেঙে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। মৌলভীবাজারে বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশু ও এক কিশোর মারা গেছে। সারা দেশ থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- সিলেট : সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেট জেলায় আরও দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। জেলার নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যদিও বুধবার রাত থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সিলেটে ভারী বৃষ্টিপাত হয়নি। ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতেও তুলনামূলক কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। কুশিয়ারা ছাড়া বাকি সবকটি নদীর পানি কিছুটা কমেছে। তবে এখনো বইছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে এ দুই পয়েন্টে গেল ২৪ ঘণ্টায় যথাক্রমে ২২ ও ১৪ সেন্টিমিটার কমেছে। কুশিয়ারা নদীর পানি গেল ২৪ ঘণ্টায় আমলসীদ, শেওলা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও শেরপুর পয়েন্টে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের আসামের পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হওয়ায় কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। কুশিয়ারার আমলসীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮১ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জে ১০২ সেন্টিমিটার ও শেরপুরে ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লোভা, সারি, ধলাই, ডাউকি ও সারিগোয়াইন নদীর পানি গেল ২৪ ঘণ্টায় কিছুটা কমেছে। সুরমাসহ অন্য নদীগুলোর পানি কিছুটা কমায় গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে কুশিয়ারার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, ওসমানীনগর, বিশ্বনাথ ও গোলাপগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী জানান, জৈন্তাপুরের কিছু কিছু এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। লোকজন বাড়িঘর পরিষ্কার করছেন। বৃষ্টিপাত না হলে দু-এক দিনের মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা লোকজন বাড়ি ফিরতে শুরু করবেন। তবে এখনো বন্যায় অনেক সড়ক জলমগ্ন রয়েছে বলে জানান তিনি। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সিলেট নগর ও জেলার ১৩টি উপজেলা মিলে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বন্যা আক্রান্ত ওসমানীনগর উপজেলা। ওই উপজেলায় পানিবন্দি রয়েছেন ১ লাখ ৮৫ হাজার জন। এরপরই গোয়াইনঘাটে বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ২০০। এ ছাড়াও সিলেট নগরে ৫৫ হাজার, সদর উপজেলায় ৭৫ হাজার ৪৬৫, বিশ্বনাথে ৩৭ হাজার ৫৭৬, ফেঞ্চুগঞ্জে ১৭ হাজার ৮৪৮, দক্ষিণ সুরমায় ২৯ হাজার ৫৫০, বালাগঞ্জে ১৮ হাজার ২৮০, কোম্পানীগঞ্জে ৯৫ হাজার ৫০০, জৈন্তাপুরে ৯০ হাজার ১৬, কানাইঘাটে ৪২ হাজার ৩৫১, জকিগঞ্জে ৮৫ হাজার ২৫২, বিয়ানীবাজারে ৫২ হাজার ১০০ ও গোলাপগঞ্জে ২৮ হাজার ১৬৬ জন পানিবন্দি রয়েছেন। বন্যার্তদের নিরাপদ আশ্রয়ে আনার জন্য সিলেট নগরে ৮০টি ও জেলার ১৩টি উপজেলায় ৬৯৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। নগরের আশ্রয় কেন্দ্রে ২ হাজার ৬০০ জন এবং উপজেলাগুলোতে ১৯ হাজার ১৮৬ জন বন্যার্ত আশ্রয় নিয়েছেন।

সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানান, বন্যা আক্রান্ত এলাকা ও আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে সিলেটে বন্যায় বিদ্যুৎ বিভাগের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৬৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। বিভাগে চলমান বৃষ্টিপাত ও উজান হতে বয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) ও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সিলেট জোনের বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, লাইন, ট্রান্সফরমার ও বৈদ্যুতিক পোলের ক্ষয়ক্ষতির জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ দুঃখ প্রকাশ করছে। জানা যায়, বিতরণ অঞ্চল, বিউবো, সিলেটের অধীনে ৩৩/১১ কেভি মোট ২১টি উপকেন্দ্রের মধ্যে সব উপকেন্দ্রই বর্তমানে চালু রয়েছে, যার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল রয়েছে। বিতরণ অঞ্চল, বিউবো, সিলেট বিভিন্ন শ্রেণির মোট গ্রাহক সংখ্যা ৫,৬১,০৬৯ জন। সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা ২২৫ মেগাওয়াট। বিতরণ অঞ্চল, বিউবো, সিলেট এলাকায় ৯টি ১৩২/৩৩ কেডি গ্রিড উপকেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া হয়। সিলেট বিভাগে চলমান বৃষ্টিপাত ও উজান হতে বয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার প্রভাবে ৩৩/১১ কেভি ২১টি উপকেন্দ্রের মধ্যে ৭টি উপকেন্দ্রের অভ্যন্তর ইয়ার্ডে পানি প্রবেশ করলেও নিরাপদ দূরত্বে থাকায় উপকেন্দ্রগুলো চালু রয়েছে। সিলেট জোনে বন্যায় বিদ্যুৎ বিভাগের প্রাথমিকভাবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৯৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বিতরণ জোনের আওতাধীন সব এলাকাই কম-বেশি বন্যাকবলিত হওয়ায় বন্যার পানি কমার পর প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য নিরূপণ করা সম্ভব হবে।

সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জ জেলার সবগুলো নদনদীর পানি রয়েছে বিপৎসীমার ওপরে। পানিবন্দি প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মানুষ। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গ্রামীণ বেশির ভাগ সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ভোগান্তি বেড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গতকাল বিকাল ৫টায় জেলার প্রধান নদী সুরমার পানি সুনামগঞ্জে বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার, ছাতকে ১২৯ সেন্টিমিটার এবং দিরাই পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৫৫ মিলিমিটার। এদিকে বন্যা প্লাবিত সুনামগঞ্জ শহরের নতুনপাড়া, শান্তিবাগ, হাজীপাড়া, কাজির পয়েন্ট, উকিলপাড়া, নবীনগর, সুলতানপুর এলাকা থেকে আস্তে আস্তে নামছে বানের পানি। এসব এলাকার অনেক মানুষ এখনো পানিবন্দি।

জেলা প্রশাসন জানায়, বন্যায় জেলার ১২ উপজেলায় ১৩০৬ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মানুষ। সরকারিভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৬৯৪টি আশ্রয় কেন্দ্র। সেগুলোতে ২৪ হাজার বন্যার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, সুনামগঞ্জের পাশাপাশি ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকায় নদনদীর পানি দ্রুত কমছে। এই ধারা বজায় থাকলে দ্রুত পানি নেমে যাবে।

হবিগঞ্জ : কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল নবীগঞ্জে কুশিয়ার নদীর বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। এতে একে একে ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ। এরই মধ্যে বন্যাকবলিতরা আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটছেন। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বন্যা মোকাবিলায় জেলার ৯টি উপজেলায় ৮৮টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ৪২০ মেট্রিক টন চাল, ৭৮ বান্ডিল টিন ও ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, খোয়াই নদীর পানি কমলেও বাড়ছে কুশিয়ারার পানি। সকাল ৯টায় কুশিয়ারার পানি শেরপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার, মার্কুলি পয়েন্টে ৩০ এবং আজমিরীগঞ্জে ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

রংপুর : তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে গতকালও বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। গঙ্গাচড়া উপজেলাতেও পানি বৃদ্ধির কারণে হুমকির মুখে পড়েছে বসতভিটা ও আবাদি জমি। ভাঙন ঠেকাতে সেখানে কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আনছার আলী বলেন, তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় খেতের বাদাম, পাটখেতসহ অন্যান্য ফসল তলিয়ে গেছে। কয়েক শ পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চলের দুধকুমার, তিস্তা ও ধরলা নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে এবং কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর জেলার কতিপয় নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এদিকে তিস্তা নদীর পানির তোড়ে গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়ন পরিষদ-সংলগ্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার রাতে সেখানে প্রায় ১০০ মিটার অংশে ভাঙন শুরু হয়। খবর পেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা রাত থেকেই সেখানে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন থেকে ঘরবাড়ি রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে। ভাঙন প্রতিরোধে সেখানে ১৪ হাজার ৪২৩টি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী পিয়াস চৌধুরী। লক্ষীটারি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল্লাহিল হাদি বলেন, তার ইউনিয়নে অনেকেই পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সবগুলো নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে নদীর তীরবর্তী ও নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হচ্ছে। এসব এলাকার বেশ কিছু ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন ফসল পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। নদনদীগুলোর পানি বৃদ্ধির কারণে কামারজানি, হরিপুর, ফজলুপুর, কাপাসিয়া, এরেন্ডাবাড়ি, ঘাগোয়া, তারাপুর এলাকায় পানি উঠতে শুরু করছে। গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলে বেশকিছু স্থান প্লাবিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে সুন্দরগঞ্জের কাপাসিয়া এলাকায় পানি বৃদ্ধির ফলে কিছু সংখ্যক ঘরবাড়িতে পানি জমেছে। ধীরে ধীরে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এসব এলাকার পানিবন্দি মানুষ গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, গাইবান্ধার সবগুলো নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ভাঙন রোধে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। 

নেত্রকোনা : টানা পাহাড়ি বর্ষণে নেত্রকোনার কলমাকান্দায় উব্দাখালি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। দুর্ভোগে পড়েছেন নদীপাড়ের মানুষ। যদিও বুধবার বিকাল থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত উব্দাখালি নদীর পানি বাড়েনি। বুধবার বিকালে বিপৎসীমার ৫১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গতকাল সকালে ৪ সেন্টিমিটার কমে ৪৭ সেন্টিমিটারে নেমেছে। কলমাকান্দা থেকে মনতলা দিয়ে মহিষাসুরা হাওরের সড়কে পানি উঠেছে। এ সড়কের পাশের বাড়িঘরের মানুষগুলো পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছে। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ পরিদর্শন করে ২৫টি পরিবারে শুকনো খাবার প্যাকেট দিয়ে গেছেন। এদিকে ৫ থেকে ৬টি পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে বলেও জেলা প্রশাসক নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, যথেষ্ট পরিমাণ সরকারের চাল মজুত রয়েছে। কোনো ধরনের সমস্যা হবে না।

এদিকে নদীপাড়ের সদর ইউনিয়নের সাউতপাড়া, মনতলা, ইসবপুর, কেশবপুর, ইব্রাহিমপুরসহ পার্শ্ববর্তী বড়খাপন ইউনিয়নের প্রায় সবগুলো গ্রাম এবং নাজিরপুর ইউনিয়নের দিলুরা, ফকির চান্দুয়াইন, পাচকাটা গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বেশি দুর্ভোগের মধ্যে নিম্নআয়ের মানুষ। তাদের দাবি, এসব এলাকার প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ পানিবন্দি। অনেকেই বাড়িঘরে থাকতে না পেরে শহরে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।  যারা কষ্ট করে রয়েছেন তাদের বাড়ির ভিতরে পানি থাকায় হচ্ছে না রান্না-খাওয়া। চলছে শুকনো খাবার দিয়ে। এদিকে উঁচু দু-একটি দোকান থেকে শুকনো খাবারের জোগান দিচ্ছেন বাড়ির অভিভাবকরা। তবে অনেকের নৌকা না থাকায় পানি ভেঙে বাড়ির বাইরে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে।

লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল বিকালে ব্যারাজ পয়েন্টে পানি ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও তিস্তা রেলসেতু পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানান লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্লাহ। পানি বাড়ায় নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। শুরু হয়েছে নদীভাঙন। নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের গরীবুল্লাহ পাড়া, বারোঘরিয়া, গোবরধন, সদর উপজেলার কালমাটি এলাকার অন্তত ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়া এসব নিম্নাঞ্চলে দেখা দিয়েছে নদীভাঙনসহ নানা ভোগান্তি। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ রাস্তাঘাট, কৃষকের ধান, বাদাম, মরিচসহ বিভিন্ন ফসলের খেত। আর বাড়িঘরে পানি থাকায় খাওয়া, ঘুমসহ সব কাজে সৃষ্টি হয়েছে ভোগান্তির। গতকাল বিকাল ৩টায় লালমনিরহাটের হাতিবান্ধায় অবস্থিত তিস্তার ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫২.০৭ মিটার। যা বিপৎসীমার মাত্র ৮ সেন্টিমিটার নিচে। একই সময় তিস্তা রেলসেতু পয়েন্টে পানি রেকর্ড করা হয় ২৯ মিটার। যা বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপরে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার রায় বলেন, টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তিস্তাসহ লালমনিরহাটের সবকটি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যারাজ পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম না করলেও তিস্তা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তবে পানি দ্রুত নেমে যাবে। নদীতে পলি পড়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে আসায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

কুড়িগ্রাম : তিস্তা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা নদনদীসহ ১৬ নদীর পানি বেড়েই চলছে। ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ও তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাফসান জানি বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও এখনো বিপৎসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে এসব নদনদীর পানিও বিপৎসীমা অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যমতে, নদীর পানি বাড়ার কারণে নদনদীর অববাহিকার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে এসব এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন সড়ক। ডুবে গেছে সবজি খেতসহ বিভিন্ন উঠতি ফসল। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, জেলার ওপর দিয়ে ১৬টি নদী প্রবহমান। এর মধ্যে ধরলা ও তিস্তা নদীর দুটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে রাজারহাট, নাগেশ্বরী ও সদর উপজেলার নিচু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দুর্যোগকবলিত মানুষের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৯১ জন। উপজেলা পর্যায়ে ১৪৪ মেট্রিক টন জিআর চাল এবং নগদ ১০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ত্রাণ হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ৪০৪টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

নীলফামারী : ভারী বর্ষণ এবং উজানের ঢলে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার বুড়িতিস্তা নদীর বাঁধ ভেঙে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার ভোররাতে উপজেলার সুন্দরখাতা নামক স্থানে বুড়িতিস্তা নদীর মূল বাঁধের প্রায় ৬০ মিটার অংশ ভেঙে দ্রুত আশপাশের ১০টি গ্রামে পানি ঢুকে পড়ে। এতে পানিতে তলিয়ে গেছে বেশকিছু জমির ফসল ও আমন ধানের বীজতলা। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেকেন্দার আলী বলেন, বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ওই এলাকার অন্তত ১ হাজার বিঘা আবাদি জমি সাময়িক পতিত হয়ে পড়বে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা দেওয়া হবে।

সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। পানি বাড়ায় ইতোমধ্যে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বন্যার শঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে। ছোট থেকে মাঝারি আকারের বন্যা হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গতকাল সকালে সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধের হার্ডপয়েন্টে যমুনা নদীর পানির সমতল রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ৭৭ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় ৩৭ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১ দশমিক ১৩ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপৎসীমা-১২ দশমিক ৯০ মিটার)। এর আগে বুধবার পানি বেড়েছে ৪৩ সেন্টিমিটার। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানান, জুন মাসের শুরুতে যমুনায় পানি বাড়া শুরু হয়। ৩ জুন থেকে অস্বাভাবিকভাবে পানি বাড়লেও এক সপ্তাহ পর কমতে থাকে। এরপর ১৮ জুন থেকে আবার দ্রুতগতিতে বাড়ছে যমুনার পানি। আরও চার-পাঁচ দিন যমুনায় পানি বাড়বে। এতে বিপৎসীমা অতিক্রম করে ছোট থেকে মাঝারি ধরনের বন্যা হতে পারে।

মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশু ও এক কিশোর মারা গেছে। গতকাল দুপুরে চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের শ্যামেরকোনা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। মৃতরা হলো- পশ্চিম শ্যামেরকোনা গ্রামের পচন মিয়ার ছেলে ছাদি মিয়া (৮) ও একই গ্রামের জমির মিয়ার ছেলে হৃদয় মিয়া (১৭)। পানিতে খেলতে নেমে সাঁতার না জানায় দুজনই ডুবে যায়।

চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আকতার উদ্দিন জানান, ধলাই নদীর বাঁধ ভেঙে শ্যামেরকোনা গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি পানিতে ডুবে গেছে।

সর্বশেষ খবর