রবিবার, ২৩ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ-ভারত ১০ চুক্তি সমঝোতা

কূটনৈতিক প্রতিবেদক ও নয়াদিল্লি প্রতিনিধি

বাংলাদেশ-ভারত ১০ চুক্তি সমঝোতা

নয়াদিল্লিতে গতকাল দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতের প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -পিআইডি

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা নতুন, বাকি তিনটি আগের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় নবায়ন করা হয়েছে।

গতকাল দুপুরে নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে এসব চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এ ছাড়া বৈঠক শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, বাংলাদেশের রোগীদের জন্য মেডিকেল ক্যাটাগরিতে ই-ভিসা ইস্যু করা হবে এবং তিস্তা চুক্তির জন্য ভারতের পক্ষ থেকে একটি কারিগরি দল খুব শিগগির বাংলাদেশ সফর করবে। সেই সঙ্গে রংপুরে একটি সহকারী হাইকমিশন খুলবে ভারত।

বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং আঞ্চলিক অংশীদার। বাংলাদেশ সব সময়ই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন,  ভারতের ‘বিকশিত ভারত’ এবং বাংলাদেশের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়া একসঙ্গে হবে, যৌথ সহযোগিতায়। দুই দিনের সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সন্ধ্যায় দিল্লি ত্যাগ করে রাতে ঢাকা এসে পৌঁছান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সকালে নয়াদিল্লির ফোরকোর্টে রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছালে স্বাগত জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মোটরবহরকে পাহারা দিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের গেট থেকে ফোরকোর্টে নিয়ে যায়। এরপর তাঁকে লালগালিচা সংবর্ধনা ও গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এ সময় বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীত গীত হয়। সশস্ত্র সালাম গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন।

পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লাইন অব প্রেজেন্টেশনে দুই দেশের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচয় করিয়ে দেন। রাষ্ট্রপতি ভবনের এ কর্মসূচি শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাজঘাট যান। সমাধিসৌধে পৌঁছালে রাজঘাট সমিতি তাঁকে স্বাগত জানায়। ভারতের এ মহান নেতার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় তিনি সমাধিতে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেন। পরে তিনি পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন।

রাজঘাটের আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রধানমন্ত্রী যান হায়দরাবাদ হাউসে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একান্ত ও দুই দেশের প্রতিনিধিসহ দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ের বৈঠক হয়। এরপর দুই দেশের সরকারপ্রধানের উপস্থিতিতে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলো স্বাক্ষর হয়। এর মধ্যে ম?ধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল পার্টনারশিপ চুক্তি, বাংলাদেশ গ্রিন পার্টনারশিপ চুক্তি; সমুদ্র সহযোগিতা ও ব্লু-ই?কোন?মি বিষয়ক সমঝোতা স্মারক, ভারতের ইন-স্পেস এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা স্মারক, দুই দেশের রেল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সংযোগসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক, সমুদ্রবিষয়ক গবেষণায় দুই দেশের সমঝোতা স্মারক, কৌশলগত ও অপারেশনাল খাতে সামরিক শিক্ষা সহযোগিতায় ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজ, ওয়েলিংটন-ইন্ডিয়া এবং মিরপুর ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের মধ্যে সমঝোতা স্মারক। এ ছাড়া নবায়ন করা হয়েছে স্বাস্থ্য ও ওষুধ সংক্রান্ত পুরনো সমঝোতা স্মারক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রশমনে ভারতের ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি, বাংলাদেশ ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান সমঝোতা এবং মৎস্যসম্পদের উন্নয়নে বিদ্যমান সমঝোতা। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, এ সফরটির বিশেষত্ব হলো এনডিএ সরকারের তৃতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ভারতের প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি। গত এক বছরে আমরা ১০ বার বৈঠক করেছি, কিন্তু আজকের বৈঠকটি বিশেষ। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের তৃতীয় মেয়াদের সরকারের প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি। আমাদের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি, অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি, ভিশন সাগর এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশনের জন্য বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর আমরা বেশ কয়েকটি উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয়ে তুলে ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ ভারতীয় রুপিতে লেনদেন শুরু করেছে। ভারতীয় গ্রিড ব্যবহার করে নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে যাচ্ছে। দুই দেশ পদ্মা চুক্তি নবায়নে কারিগরি পর্যায়ে আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের তিস্তা নদীর সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা পরিদর্শনের জন্যও (ভারতের) একটি কারিগরি দল বাংলাদেশ সফর করবে। আগরতলা দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ষষ্ঠ রেলপথ চালু হয়েছে জানিয়ে মোদি বলেন, খুলনা-মোংলা বন্দর দিয়ে আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় কার্গো সার্ভিস শুরু হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ভারতীয় রুপির বাণিজ্য শুরু হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা (পদ্মা) নদীর ওপর দিয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম রিভার ক্রুজ সম্পন্ন হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম আন্তসীমান্ত মৈত্রী পাইপলাইন সম্পন্ন হয়েছে। ভারতীয় গ্রিড ব্যবহার করে নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি আঞ্চলিক সহযোগিতার উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নরেন্দ্র মোদি বলেন, চিকিৎসার জন্য ভারতে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ই-মেডিকেল ভিসা চালু করবে ভারত। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের সুবিধার্থে রংপুরে নতুন সহকারী হাইকমিশন খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এবার মহাকাশের ডিজিটাল ক্ষেত্রে কানেকটিভিটি বাড়বে। ভারত মৈত্রী উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করবে। মোদি বলেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য সুসংহত আর্থিক অংশীদারি চুক্তির আলোচনা শুরু করতে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দো প্যাসিফিক আর্থিক প্রকল্পে বাংলাদেশের যোগদানের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। মোদি আশা করেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্জিত হবে।

বৈঠক শেষে শেখ হাসিনা বলেন, বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে। উভয় দেশ একটি ‘রূপকল্প’ অনুমোদন করেছে, যাতে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে দুই দেশই পরিচালিত হতে পারে। আমরা টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ডিজিটাল এবং সবুজ অংশীদারির বিষয়ে একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে সম্মত হয়েছি।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ‘ক্রমাগত দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দুই পক্ষের বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে, যেখানে আমরা পারস্পরিক স্বার্থের অন্য বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছি। এসবের মধ্যে রাজনীতি ও নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও সংযোগ, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছি। তিনি বলেন, আমরা আমাদের জনগণ ও দেশের উন্নতির জন্য একে অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছি। যেহেতু নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে ঢাকা ও দিল্লি নতুনভাবে পথচলা শুরু করেছে, সে ধারাবাহিকতায় আমরা ‘রূপকল্প-২০৪১’-এর মাধ্যমে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘বিকশিত ভারত-২০৪৭’ অনুসরণ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছি। বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির সচিবালয়ে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিশেষ ফ্লাইটে নয়াদিল্লি ত্যাগ করে রাত ৯টার দিকে ঢাকা এসে পৌঁছান।

তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্প সমীক্ষার জন্য কারিগরি দল পাঠাবে ভারত : নয়াদিল্লি প্রতিনিধি জানান, নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশের তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্প সমীক্ষার জন্য ভারত কারিগরি দল পাঠাবে। ২০২৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে। তার পুনর্নবীকরণ করার জন্য উভয় দেশের কারিগরি বিশেষজ্ঞরা আলোচনা শুরু করবেন। অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদি অমীমাংসিত ইস্যু। দুই দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে একমাত্র গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষর হলেও তিস্তাসহ আলোচনায় থাকা ৮টি নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। গঙ্গা চুক্তির পর আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারটি। ২০১১ সালে দুই দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সব প্রস্তুতি নেওয়া হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় তা সম্পন্ন করা যায়নি। এরপর ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এখন বাংলাদেশের তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের পাশাপাশি বিনিয়োগে আগ্রহী হয়েছে ভারত। ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে প্রস্তাব। সেই বিনিয়োগের জন্য প্রাথমিক সমীক্ষার জন্য কারিগরি দল পাঠাচ্ছে ভারত।

সর্বশেষ খবর