সোমবার, ২৪ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

ট্রানজিট পয়েন্ট নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

মাদকের ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ হয়েই মাদক ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। আর এই মাদকের ‘ডিপো’ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে রূপগঞ্জের ছনপাড়া। জেলায় স্পটভিত্তিক মাদক ব্যবসায় জড়িতদের প্রথমদিকে রয়েছেন পুলিশের অসাধু কর্মকর্তা, তাদের সোর্স, রাজনীতিবিদ ও শতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্য। পাইকারির মতোই জেলা শহর এবং থানার অলিগলিতে ২০০ মাদক স্পট সরগরম থাকে দিন-রাতের বিভিন্ন সময়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন সময় পুলিশের অভিযানে খুচরা এবং মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান মাদকের মূল শেল্টারদাতারা।

একাধিক সূত্র মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক বিশাল একটি অংশ রয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলার সীমানায়। জেলাকে বেষ্টিত করে রেখেছে শীতলক্ষ্যা, বুড়ীগঙ্গা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও ধলেশ্বরসহ ৫টি নদী। নারায়ণগঞ্জের খুব কাছাকাছি ভারত সীমান্ত সংলগ্ন দুই জেলা কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এ দুটি জেলা দিয়ে নানাভাবে মাদক এনে নারায়ণগঞ্জকে ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ বানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আবার কক্সবাজার থেকে নৌপথে নানা কায়দায় মাদক ছনপাড়ায় নিয়ে আসছে মাদক মাফিয়ারা। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে  দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

একটি সংস্থার তালিকা থেকে জানা যায়, এ জেলার সাতটি থানার মধ্যে সদর থানায় ১৭৬ জন, ফতুল্লায় ১০৯ জন, সিদ্ধিরগঞ্জ ৯৯ জন, বন্দরে ৬০ জন, রূপগঞ্জে ৩৮ জন, আড়াইহাজারে ২১ জন এবং সোনারগাঁয়ে ১৭ জন মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন। থানাগুলোর বিভিন্ন এলাকায় অন্তত দুটি করে স্পট রয়েছে। তবে বন্দরে প্রায় ৫০টি, নারায়ণগঞ্জ সদরে ৬০টি ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ৭০-৮০টি ভাসমান মাদক স্পট রয়েছে। পুরো জেলার মধ্যে চিহ্নিত মাদকের সবচাইতে বড় স্পট রূপগঞ্জের ছনপাড়ায়। এসব মাদক ব্যবসার মূল শক্তি হচ্ছে অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশের সোর্স। শেল্টারদাতাদের সঙ্গে ভাসমান মাদক ব্যবসায়ীদের একটি কৌশলগত চুক্তি রয়েছে। এ চুক্তির শর্তেই আটক মাদক ব্যবসায়ীদের পরিবারের দেখভাল ও তাদের জামিনের ব্যবস্থা করে দেন শেল্টারদাতারা। তাদের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।

অভিযোগ রয়েছে, নারায়ণগঞ্জের অনেক স্বনামধন্য আইনজীবী মাদক মামলার জামিনের ‘উকিল’ হিসাবে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে পরিচিত। জেলার বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ জানান, প্রকাশ্যে মাদক স্পট থেকে অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও তাদের সোর্সরা মাসোহারা নেয়। ফলে মাদক ব্যবসায়ীরা বীরদর্পে জেলার প্রতিটি স্পটে মাদক ব্যবসা করে যেতে পারছে। এদের পুলিশে ধরিয়ে দিলেও লাভ হয় না। কয়দিন পর আবার জামিনে বের হয়ে আসে।

সোনারগাঁ থানা সূত্রে জানা গেছে, সোনারগাঁয়ে ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় মাদক ব্যবসায়ীদের স্বর্গরাজ্য। সোনারগাঁয়ে ৫৯৮ জন তালিকাভুক্ত মাদক বিক্রেতা রয়েছেন। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক ও মেঘনা নদী এবং শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে এ মাদক প্রবেশ করে উপজেলা বৈদ্যের বাজার, জিয়ানগর, ভাটিবন্দর, ভবনাথপুর, পিরোজপুর, কোরবানপুর, আষাড়িয়ার চর, দুধঘাটা,  মোগরাপাড়া, বারদীসাদিপুর, কাঁচপুর, জামপুরসহ প্রায় শতাধিক গ্রামের বিভিন্ন অলিগলিতে চলছে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি।

জানা যায়, গত ৯ জুন সোনারগাঁয়ে মোগরাপাড়া ইউনিয়নের বাড়ি মজলিস গ্রামে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে ফজলে রাব্বী (২২) নামের এক তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। রাত ১০টার দিকে রাব্বীকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান স্থানীয়ভাবে পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত শাহ আলম। তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছলে ওই এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী অন্তর ওরফে অন্তু, শান্ত ও মিন্টুর নেতৃত্বে ৫/৬ জনের একটি দল রাব্বী ও শাহ আলমের ওপর হামলা চালায়। এ সময় তারা উভয়কে কুপিয়ে আহত করে পালিয়ে যায়। ঘটনার পর স্থানীয়  লোকজন আহত দুজনকে সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে রাব্বীকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। বাড়ি মজলিস এলাকাটি দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা ও অপরাধীদের আখড়া হিসেবে পরিচিত।

এর আগে গত ১২ মে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা টোলপ্লাজা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬০ হাজার ইয়াবা টেবলেটসহ মো. ইসহাক (২৪) নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে পুলিশ। এ সময় মাদক পরিবহন কাজে ব্যবহৃত (ঢাকা মেট্রো-ছ ৭১-২২৬৬) একটি অ্যাম্বুলেন্স জব্দ করা হয়। সোনারগাঁ থানার ওসি কামরুল ইসলাম বলেন, নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে অনেককে আটকের পর মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। তবুও অনেক সময় নানা কায়দায় পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদক ছড়িয়ে দিতে তৎপর রয়েছে অপরাধীরা। আমরা এসব চক্রের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

সর্বশেষ খবর