শিরোনাম
সোমবার, ২৪ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাতে বদলে যায় ঠাকুরগাঁও

আবদুল লতিফ লিটু, ঠাকুরগাঁও

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আমার সন্তান ঢাকায় গিয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। নেশার টাকার জন্য প্রায়ই বাসায় ভাঙচুর করত সে। কখনো তার হাতে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছি- বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন অসহায় এক বাবা। তিনি পেশায় কলেজশিক্ষক। নাম না প্রকাশের শর্তে ভারী হয়ে আসা কণ্ঠে তিনি আরও জানান, লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারছি না, পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আর সন্তানকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানোর চেষ্টা করছি। এমন সংকটে শুধু তিনি একা নন, দেশের উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের অনেক পরিবারের চিত্র এটি। সুকৌশলে মিয়ানমারে উৎপাদিত মাদক ইয়াবা ট্যাবলেট, সীমান্ত পথে ভারত থেকে বানের পানির মতো আসা ফেনসিডিল, গাঁজা যুবসমাজকে বিপথগামী করে দেশ ও জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পুরো শহর ঘুরে সব বয়সের মানুষের সঙ্গে কথা বলে যে চিত্র পাওয়া  গেছে তাতে ২৪ ঘণ্টায় ঠাকুরগাঁওকে দুভাবে চিনতে হয়। দিনের সঙ্গে রাতের কোনো মিল নেই। সকাল থেকে শেষ বিকাল পর্যন্ত শহরের যে চিত্র দেখা যায়, তা অন্ধকার নামলেই কোথায় যেন হারায়। ঠাকুরগাঁওয়ে সন্ধ্যার পর দ্রুত পাড়া-মহল্লার চিত্র পাল্টে যায়। রাস্তার পাশে ঝুপড়ি ঘর, টং দোকান, রিকশার গ্যারেজ, অফিসপাড়ার নিরিবিলি স্থান ও ফাঁকা জায়গায় উঠতি বয়সের তরুণ-যুবকদের আড্ডা অনেকটা অঘোষিত নিয়ম হয়ে গেছে। কখনো বয়স্করা এভাবে ঘোরাফেরার কারণ জানতে চাইলে একটাই জবাব- ‘স্কুল-কলেজ নেই, সারা দিন পড়াশোনার পর হাতে কোনো কাজ থাকে না। তাই বন্ধুরা মিলে সন্ধ্যার পর ঘুরতে বের হই।’ তবে রাত ১১টার পর শহর একেবারেই ফাঁকা হয়ে পড়ে। সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা এ পাঁচ ঘণ্টাই ঠাকুরগাঁওয়ের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যমতে, মাদকাসক্তদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছর। ঠাকুরগাঁও শহর ছাড়িয়ে উপজেলা পর্যায়ে মাদক বহনে ব্যবহার কারা হয় নারী ও শিশুদের। কিন্তু মূলহোতারা সব সময় থাকে আড়ালে। মোবাইল কোর্ট ও পুলিশের অভিযানে প্রায়ই বহনকারী ধরা পড়ে। পুলিশ বলছে, ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন জায়গায় বাড়ির মধ্যে গাঁজা আবাদের খোঁজ পাওয়া গেছে। এরপরই অভিযান চালিয়ে শতাধিক গাছ ধ্বংস করে ফেলা হয়। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত মাদক চোরাচালানদের আটক করা হচ্ছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। অন্যদিকে সীমান্ত দিয়ে অবাধে আসছে ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা, গাঁজা। ইয়াবা কক্সবাজার থেকে ঢাকা হয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে কীভাবে আসে এমন প্রশ্নের জবাব পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কেউ দিতে পারেনি। তবে একাধিক সূত্রমতে, মিয়ানমার থেকে ভারতের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলায় ঢুকছে ইয়াবা। সীমান্ত এলাকায় কখনো গরুর পাল, কখনো তেলের কনটেইনারে ঠাকুরগাঁওয়ে মাদক প্রবেশ করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়দের অনেকেই জানান, সীমান্তের দুই দিকে রাতভর চলে মাদক কেনাবেচা। অবশ্য বিজিবির সূত্র এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, সীমান্তে রাতদিন কড়া নজরদারি রয়েছে। এদিকে মাদকের অবাধ কেনাবেচা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জেলা গোয়েন্দা শাখার এসআই নবিউল ইসলাম বলেন, সীমান্তের ৩ কিলোমিটারের মধ্যে পুলিশ প্রবেশ করতে পারে না। তারপরও পুলিশ মাদক প্রবেশ ঠেকাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সূত্রমতে, ঠাকুরগাঁও সদর দফতরের ১৩ জনবলের মধ্যে আছে মাত্র ছয়জন। এ ছয়জনকে নিয়ে একটি জেলার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করা কতটা কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। নেই কোনো আগ্নেয়াস্ত্র। তদুপরি জেলা প্রশাসনের পরামর্শে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে টাস্কফোর্সের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ঠাকুরগাঁও জেলা পুলিশ সুপার উত্তম কুমার পাঠক বলেন, মাদক মোকাবিলায় প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছে জেলা পুলিশ। প্রতিদিন বিভিন্ন থানায় ধরা হচ্ছে। মাদক নিয়ে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ছাড় নেই। ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল তানজীর আহম্মদ বলেন, সীমান্তে আমাদের বিজিবির পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি রয়েছে। মাদক পারাপার সীমান্ত দিয়ে করা সহজ নয়, কারণ বিজিবি অনেক কঠোর অবস্থানে। আমরা প্রায় সময় মাদকের চালান ধরছি।

সর্বশেষ খবর