মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা
সংসদ অধিবেশন

অর্থ পাচার নিয়ে তোলপাড়

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা ৫১ হাজার কোটি, ১০ মাসে বিদেশিরা রেমিট্যান্স নিয়েছে ১৩০ মিলিয়ন ডলার, শীর্ষে ভারত ৫০ মিলিয়ন

নিজস্ব প্রতিবেদক

অর্থ পাচার নিয়ে তোলপাড়

অর্থ পাচার নিয়ে গতকাল বেশ তোলপাড় হয়েছে সংসদে। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা ৫১ হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি আরও জানান, ১০ মাসে বিদেশিরা রেমিট্যান্স নিয়েছে ১৩০ মিলিয়ন ডলার। সবচেয়ে বেশি নিয়েছে ভারত, ৫০ মিলিয়ন ডলার।

দুর্নীতির মচ্ছব বন্ধ করতে এখনই ‘বিশেষ কমিশন’ গঠন করার আহ্বান জানিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বলেছেন, দুর্নীতির এ বিস্তার রোধ করা না গেলে হিমশৈলের ধাক্কায় দেশের উন্নয়নের সলিলসমাধি হবে।

গতকাল জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ কথা বলেন। একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের অর্থ সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও বিচার করে কঠিন শাস্তির প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। মেনন বলেন, নিউইয়র্কের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স-এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন ধনী উৎপাদনে পৃথিবীর নেতৃস্থানে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩ সালের শেষ ভাগে কোটিপতি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৮৬টি, যা ২০০০ সালে ছিল ৩ হাজার ৪৪২টি। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের অবাক করা ধনী উৎপাদনে ঈর্ষান্বিত না হয়ে এটাকে ভালোভাবে নেওয়া উচিত। এ যুক্তি গ্রহণ করা যেত যদি এই সম্পদ দেশে বিনিয়োগ হতো। তা না হয়ে এ অর্থ সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। মার্কিন ফাইনান্সিয়াল ইনট্রিগেটি ইনস্টিটিউশন দেখিয়েছে যে, বছরে ৭ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে কানাডার বেগম পাড়ায়, মালেশিয়ার সেকেন্ড হোমে, সিঙ্গাপুর, দুবাইয়ের আধুনিক শপিং মল, রিয়েল এস্টেট ও হুন্ডি ব্যবসায়। এ টাকার লভ্যাংশও দেশে আসছে না। পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও নেই। অথচ প্রবাসীরা বিদেশে হাড়ভাঙা খাটুনির যে আয় দেশে পাঠায়, তার ওপর কর বসানো হচ্ছে। তিনি বলেন, রাতারাতি এ অর্থ সম্পদ উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক লুট ও দুর্নীতি। ২০০৯ সালে ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকার ঋণ এখন ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। পুনঃতফসিলীকরণ ও অবলোপন ধরলে এর পরিমাণ ৪ থেকে ৫ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়াবে।

সরকারের মধ্যে রাসেলস ভাইপার : হবিগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক (ব্যারিস্টার সুমন) বলেছেন, অর্থ পাচার সরকারের বড় সমস্যা। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। দুর্নীতি করলে তো সেই টাকা অর্থনীতিতে ফিরিয়ে আনা যায়। পাচার হয়ে যেই দেশে যায় সেই দেশের অর্থনীতির বাজেটে যোগ হয়। আমরা তো বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরই আনতে পারিনি, আর পাচার করা টাকা ফেরত আনব কীভাবে? অর্থ পাচারের কারণে আমাদের বাজেট সংকুুচিত হয়ে যাচ্ছে। গতকাল জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। সায়েদুল হক বলেন, সরকারের মধ্যে রাসেলস ভাইপার সাপ ঢুকে গেছে। প্রকৃতিতে যখন সাপ আসে, তখন বেজি সেই সাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই সরকারে সাপ ঢুকেছে, কিন্তু সেই সাপকে ধরার মতো বেজি নেই। তাই সাপ বেড়েই চলেছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা দুর্বল হয়ে গেছে! একজন ‘ভদ্রলোক’কেও দুদক ধরতে পারেনি, এনবিআর ধরতে পারেনি, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট ধরতে পারেনি, সেখানে এনবিআরের মতিউর রহমানকে ধরল একটা ছাগল। ছাগলকাণ্ড না ঘটলে আর ফেসবুকে ভাইরাল না হলে এই লোকের বিষয় তো সামনেই আসত না। বেনজীর-কাণ্ড! সাবেক আইজিপি! উনি এত বড় হয়ে গেলেন, মন্ত্রণালয় জানল না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানলেন না! আর কিছুদিন সময় পেলে পুরো গোপালগঞ্জ কিনে ফেলতেন এই বেনজীর আহমেদ। এটার দায় মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না। এখন কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। যদি এমন হয় যে, কিছু জমানো টাকা রয়ে গেছে যেটাকে সাদা করবেন, তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু এই সুযোগ ব্যবহার করে বেনজীর আর মতিউরের টাকাও যদি সাদা হয়ে যায়, আর এদের আদর্শের উত্তরাধিকারদের টাকাও যদি সাদা হয়ে যায়, এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু থাকবে না।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা ৫১ হাজার কোটি : দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সরকারি/বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পাওনা ৫১ হাজার ৩৯১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। গতকাল জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের প্রশ্নোত্তর পর্বে সংসদ সদস্য মোরশেদ আলমের লিখিত প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উপস্থাপিত হয়। অর্থমন্ত্রী জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত ৫৬টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকগুলোর এই পরিমাণ টাকা পাওনা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা পাওনা আছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কাছে। এ ছাড়া বড় অঙ্কের টাকার মধ্যে চিনি কলগুলোর কাছে পাওনা প্রায় ৭ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা, সার, রাসায়নিক ও ওষুধশিল্পের কাছে পাওনা ৭ হাজার ২৫০ কোটি টাকা, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কাছে পাওনা ৫ হাজার ১৮ কোটি টাকা, বাংলাদেশ বিমানের কাছে পাওনা ৪ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা।

১০ মাসে ১৩০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছেন বিদেশি নাগরিকরা : গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকরা তাদের আয় হতে ১৩০ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন (১৩ কোটি ৫৮ লাখ) মার্কিন ডলার নিজ নিজ দেশে নিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল কাদের আজাদের লিখিত প্রশ্নের জবাবে গতকাল জাতীয় সংসদে তিনি এ তথ্য জানান।

মন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের বছরে আয় সংশ্লিষ্ট তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষিত নেই। গত ১০ মাসে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকরা তাদের আয় হতে ১৩০ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজ নিজ দেশে নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫০.৬০ মিলিয়ন ডলার গেছে ভারতে। এ ছাড়া চীনে ১৪.৫৬ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১২.৭১ মিলিয়ন ডলার, জাপানে ৬.৮৯ মিলিয়ন ডলার, কোরিয়ায় ৬.২১ মিলিয়ন ডলার, থাইল্যান্ডে ৫.৩০ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাজ্যে ৩.৫৯ মিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানে ৩.২৪ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্রে ৩.১৭ মিলিয়ন ডলার, মালয়েশিয়ায় ২.৪০ মিলিয়ন ডলার ও অন্যান্য দেশে গেছে ২১.৯২ মিলিয়ন ডলার।

চট্টগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব উর রহমানের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো ব্যাংকেই আর্থিক সংকট নেই। তবে কতিপয় ব্যাংকে উচ্চ খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি ও তারল্য সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে। এ সমস্যা নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন করে কর্মকর্তা ৯টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পর্যবেক্ষক হিসেবে এবং সাতটি ব্যাংকে কো-অর্ডিনেটর হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল লতিফের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতির চলমান সংকটের মূলে যে কারণগুলো রয়েছে তা হলো- বৈশ্বিক পণ্য বাজারে সরবরাহে অনিশ্চয়তা, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া এবং দেশের বাজারে সরবরাহ শৃঙ্খলে ত্রুটি। অর্থনৈতিক এ সংকট কাটিয়ে দ্রবমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত হ্রাস পাওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হওয়ায় মানুষ আমানত তুলে বিনিয়োগ করছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাহীনতা বা মূল্যস্ফীতির কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত কমছে না।

সর্বশেষ খবর