শিরোনাম
বুধবার, ২৬ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

দেশ বিক্রির কথা বলে দালালরা

♦ দেশ বেচি না, দেশের স্বার্থও বেচি না ♦ ট্রানজিট দিলে ক্ষতি কী ♦ দেশেই থাকতে না পারলে অর্থ বানিয়ে লাভ কী ♦ তিস্তা প্রকল্প ভারত করলে সব সমস্যারই সমাধান হয় ♦ কেন্দ্রকে মমতার চিঠি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় ♦ ড. ইউনূস কর ফাঁকি দিয়েছেন, আদালতে প্রমাণিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশ বিক্রির কথা বলে দালালরা

ভারতকে রেলপথে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া নিয়ে সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা দেশ বিক্রি করে না, দেশের স্বার্থও বেচে না। বরং দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই চলি। পাকিস্তানের দালালরা দেশ বিক্রির কথা বলে।

গতকাল সকালে গণভবনে ভারত সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। সম্মেলনের শুরুতে লিখিত বক্তৃতা পড়ে শোনান প্রধানমন্ত্রী। পরে তিস্তা প্রকল্প, ভারত-চীনের সঙ্গে সম্পর্ক, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গ, ব্যাংক একীভূতকরণসহ নানা প্রশ্নের উত্তর দেন।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, দলীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফর উল্লাহ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন।

সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক জানতে চান-রেল চলাচলের জন্য ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছেন। ‘দেশ বিক্রির ষড়যন্ত্র চলছে’ বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, তা কীভাবে দেখছেন? জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা বলেন, আমার একটা প্রশ্ন আছে-বিক্রির ওজনটা কীভাবে মাপছে। কোনো কিছু বিক্রি হলে তো ওজন মাপা হয়, এখন তো অবশ্য ইলেকট্রিক মেশিন আছে। আগে তো দাঁড়িপাল্লায় হতো, কিসে মেপে বিক্রি হচ্ছে আর বিক্রিটা হয় কীভাবে? বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ, মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। শেখ হাসিনা এ দেশকে বিক্রি করে না, কারণ আমরা এ দেশ স্বাধীন করেছি, এটা ভুলে গেলে চলবে? আর যে কষ্টটা আমরা ভোগ করি সেটা আমরা জানি। যারা বিক্রির কথা বলে তারা একাত্তর সালে পাকিস্তানের দালালি করেছে। তিনি বলেন, পৃথিবীতে একটি মাত্র মিত্রশক্তি, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের রক্ত ঢেলে দিয়ে এ দেশ স্বাধীন করে দিয়েছে। আমাদের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা সেখানে ট্রেনিং পেয়েছে। পৃথিবীর যে কোনো দেশে, যেখানেই কোনো মিত্রশক্তি সহযোগিতা করেছে, তারা কিন্তু সেই দেশ ছেড়ে কোনো দিন ফেরত যায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিত্রবাহিনীকে ভারতে ফেরত পাঠানোর ইতিহাস তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এখনো জাপানে আমেরিকান সৈন্যসহ এ রকম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দেখলে সেই দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। সেখানে ভারত কিন্তু ব্যতিক্রম। তারা মিত্রশক্তি হিসেবে আমাদের পাশে থেকে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু যখনই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়েছেন তারা দেশে ফিরে যাক, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী রাজি হয়েছেন এবং তাদের ফেরত নিয়ে গেছেন। তারা যুদ্ধের সরঞ্জামাদি সবকিছু নিয়েই কিন্তু এসেছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারেন্ডার করেছিল, তাদের কাছে। আমরা কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি। কারণ ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর পরে যারা কথা বলে ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে। বিক্রিটা হয় কীভাবে সেটাই তো আমার প্রশ্ন। আসলে যারা এটা বলে তারা নিজেরাই ভারতের কাছে বিক্রি করা। ভারত নিয়ে জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার ‘মনোভাব’ নিয়েও কথা বলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা তো দেখেছি... ওপর দিয়ে ভারতবিরোধী কথা বলেছে আর ভারতে যেয়ে পা ধরে বসে থেকেছে, এগুলো আমার নিজের দেখা, জানা। এ ধরনের কথা বলার কোনো অর্থ হয় না। তিনি বলেন, যত ছোট হোক, আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আর সেই সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং স্বকীয়তা বজায় রেখেই আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে কাজ করছি।

একটা দেশের মধ্যে অন্য দেশের ট্রানজিট দিলে ক্ষতি কী-সেই প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, রেল যতগুলো বন্ধ ছিল আমরা আস্তে আস্তে খুলে দিচ্ছি। ফলে আমাদের ব্যবসাবাণিজ্য সহজ হচ্ছে। আমাদের ওই অঞ্চলের লোকজন উপকৃত হচ্ছে। তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার সুযোগ হচ্ছে। আর যেসব জিনিস আমাদের দেশে আনার সুযোগ হচ্ছে, অর্থনীতিতে এটা বিরাট অবদান রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কি চারদিকে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে, এটা হয় না। কোনো দেশ পৃথিবীতে এমন করে না। ট্রানজিট প্রসঙ্গে ইউরোপের উদাহরণ দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ইউরোপের দিকে তাকান, সেখানে কোনো বর্ডারই নাই। তাহলে কি একটা দেশ আরেকটা দেশের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে? একসময় নো-ম্যানস্-ল্যান্ড ছিল, আমরা যখন ইউরোপে গেছি, একটা গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে কাস্টমস চেক করে আবার গাড়িতে উঠতে হয়েছে। প্রত্যেকটা দেশ স্বাধীন। কই কেউ কাউকে তো বিক্রি করেনি। তাহলে সাউথ এশিয়ায় কেন বাধা দিয়ে রাখব?

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারত ও চীনের সহায়তার প্রস্তাবসংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যে প্রস্তাব দেশের মানুষের কল্যাণে আসবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের ঋণ নিলে তার রিটার্ন আসবে তাদের প্রস্তাব বিবেচনা করা হবে। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা চলছে। তাই তারা যদি আমাদের প্রজেক্ট করে দেয় আমাদের সব সমস্যার সমাধানই হয়ে গেল। চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে সরকারপ্রধান বলেন, এ পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এ পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একটানা চতুর্থবার এবং আগে ছিল একবার-এ পঞ্চমবার রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে সংসদে ছিলাম। এ নীতি মেনে চলে যাচ্ছি, এগিয়ে যাচ্ছি। কখনো প্রশ্ন আসেনি কোথায় ব্যালান্স কম হলো, এটা আসেনি। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার যে সুযোগটা দিচ্ছে সেটা হচ্ছে উন্নয়ন করার সুযোগ। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশের মানুষের কল্যাণ। দেশের উন্নয়নে কার সঙ্গে কতটুকু বন্ধুত্ব দরকার সেটা করে যাচ্ছি। ভারত আমাদের চরম দুঃসময়ের বন্ধু। আবার চীন যেভাবে নিজেদের উন্নত করেছে, সেখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সেগুলো সামনে রেখে সম্পর্ক বজায় রেখে যাচ্ছি। কেউ মনে করল এদিকে ঝুঁকলাম নাকি ওইদিকে ঝুঁকলাম। এ ঝোঁকাঝুঁকির ব্যাপার আমার নেই। শেখ হাসিনা বলেন, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আমাদের চীন প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতও প্রস্তাব দিয়েছে। অবশ্যই আমি বিবেচনা করব কোন প্রস্তাবটা দেশের মানুষের কল্যাণে আসবে, আমি সেটাই করব। সে ক্ষেত্রে ভারত যখন বলছে তারা করতে চায় এবং টেকনিক্যাল গ্রুপ পাঠাবে, অবশ্যই তারা আসবে। আমরা যৌথভাবে সেটা দেখব। চীনও একটা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। ভারতও একটা করবে। যেটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য, লাভজনক সেটাই করব। আবার ভারত যদি আমাদের প্রজেক্ট করে দেয় আমাদের সব সমস্যার সমাধানই হয়ে গেল। সেটা আমাদের জন্য সহজ হয়ে গেল। ভারতের সঙ্গে যদি তিস্তা প্রজেক্টটা করি তাহলে পানি নিয়ে প্রতিদিন প্যাঁ প্যাঁ করতে হবে না। আমরা সেই সুবিধাটা পাব। এখানে কোনো সমস্যা দেখি না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন শপথ অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলেন, গেলাম। এরপর রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ জানালেন, আমি রাষ্ট্রীয় সফরও করে এলাম। চীন আমাকে দাওয়াত দিয়েছে, আমি চীনে যাব। আমি যাব না কেন? বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়েই চলব। কার কী ঝগড়া সেটা তাদের সঙ্গে থাক। আমার না। দেশের মানুষের কতটুকু উন্নতি করতে পারি, সেটাই আমার। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ও গঙ্গা চুক্তি নবায়ন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অবস্থান সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, মমতা ব্যানার্জি চিঠি লিখেছেন উনার দেশের প্রধানমন্ত্রীকে। এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এখানে আমার তো কিছু বলার নেই। এ ব্যাপারে আমার কোনো নাক গলানোর দরকারও নেই। আমার সঙ্গে সবার সম্পর্ক ভালো। একটা কথা বলতে পারি, ভারতের দলমতনির্বিশেষে সবার সঙ্গে আমার একটা সুসম্পর্ক আছে।

টাকা বিদেশে রাখতে গিয়ে দেশ ছেড়েই ভাগতে হয় : দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু মানুষ তো লোভী হয়ে যায়। টাকাপয়সার লোভ এত বেড়ে যায় যে শেষে দেশ ছেড়েই ভাগতে হয়। তা সেই অর্থ বানিয়ে লাভটা কী হলো। এতই অর্থ বানিয়ে ফেলল যে শেষে আর দেশেই থাকা যায় না। এটা তো মানুষ চিন্তা করে না। বোধ হয় নেশার মতো পেয়ে যায়। তিনি বলেন, ব্যাংকিং সেক্টর কেউ ভালো চালাচ্ছে। কেউ খারাপ চালাচ্ছে। অনেকে ঠিকমতো চালাতে পারেন না। এটা চিরাচরিত নিয়ম যদি কোনো ব্যাংক দুর্বল হয়ে যায় তাহলে তাকে সহযোগিতা করা। একটা ব্যাংকের সঙ্গে আরেকটা ব্যাংককে মার্জ করে দেওয়া এটা যাতে ভালোভাবে চলে। সেখানকার আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ কিন্তু সরকারের দায়িত্ব। সেটাই পালন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গ ড. ইউনুস : ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, মামলা চলছে এজন্য কমেন্ট করতে চাই না। কিন্তু যখন প্রশ্ন এসেছে দু-চারটা কথা না বললে মানুষ বোধহয় ভুল বুঝতে থাকবে। তবে একটা প্রশ্ন তাদের করতে পারেন, যে আমেরিকা হোক বা ইউরোপ হোক যে কোনো দেশে কেউ যদি বছরের পর বছর ট্যাক্স ফাঁকি দেয় তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয় সে সরকার। তার উত্তরটা কিন্তু এরা দেয়নি। দ্বিতীয়ত শ্রমিকদের নিয়ে এত কথা হয় সেই শ্রমিকদের কল্যাণ ফান্ডের টাকা! সেই শ্রমিকদের টাকা যদি কেউ না দেয়, মেরে খায় তার বিরুদ্ধে এরা কী ব্যবস্থা নেবে। কী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে? সরকারপ্রধান বলেন, ইউনূসের বিরুদ্ধে আমরা বা আমাদের গভর্নমেন্ট লাগেনি। বরং আপনাদের মনে আছে, গ্রামীণ ব্যাংকটা তৈরি হয়েছিল জেনারেল এরশাদ সাহেবের আমলে। একজন এমডি খোঁজা হচ্ছিল, তখন ড. ইউনূসকে এনে সেই ব্যাংকের এমডি করা হয়। এ ব্যাংক কিন্তু তার নিজের করা নয়। সে সেখানে এমডি হিসেবে চাকরি করত এবং বেতন তুলতেন। চাকরিরত অবস্থায় তিনি এমনভাবে প্রচার করেছেন যেন এটা উনার নিজেরই করা। তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। ওই টাকা, বেতন সব কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হতো। তাদের কেউ বাইরে গেলে জিও নিয়ে যেতে হতো। ওই ব্যাংকের আইনেই ছিল ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত একজন এমডি চাকরিতে থাকতে পারবেন। ৬০ বছরের পরেও আরও ১০ বছর তিনি আইন ভঙ্গ করে ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়টি নজরে আনে। আমাদের অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভী তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন আপনার তো বয়স হয়ে গেছে। অবৈধভাবে ইতোমধ্যে ১০ বছরের বেশি আছেন। আপনি এখানে উপদেষ্টা হিসেবে থাকেন। কিন্তু তিনি এমডি পদ ছাড়বেন না। এমডি পদ তাঁকে রাখতেই হবে। ড. ইউনূস কিন্তু আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে, অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা কিন্তু কখনো সরকার করেনি। সেই দুটি মামলাতেই উনি হেরে যান। এ কথাটা ওই পত্রিকাওয়ালারা লেখেনি।

লেবার কোর্টে শ্রমিকরা কল্যাণ ফান্ডের টাকা না পেয়ে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এখনো যে তার বিরুদ্ধে যে মামলা, সেটাও সরকার করেনি। শ্রমিকদের কল্যাণ ফান্ডের টাকাটা, ২০০৬ সাল থেকে একটি পয়সা দেয়নি। তখন শ্রমিকরা মামলা করেছে। শ্রমিকরা লেবার কোর্টে মামলা করেছে সেই মামলায় সে শাস্তি পেয়েছে। এখানে আমার কী দোষ। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, গ্রামীণফোন সেটা আমিই তাকে (ইউনূসকে) দিয়েছিলাম, এটাও মনে রাখা উচিত। গ্রামীণ ব্যাংক তার আমলে প্রায় কলাপস করে যাচ্ছিল। তখন আমার সরকার ও আমি নিজে প্রথমে ১০০ কোটি টাকা, পরে ২০০ কোটি টাকা ও পরে আরও ১০০ কোটি টাকা, এই ৪০০ কোটি টাকা সরকারের পক্ষ থেকে তাকে দিয়ে ব্যাংকটাকে চালু রাখতে সহায়তা করি। তখন তিনি প্রস্তাব দিলেন একটি ফোন পেলে গ্রামের মেয়েদের ফোন দেবেন। এর থেকে যে লাভটা হবে তা গ্রামীণ ব্যাংকে জমা হবে। সেটা দিয়ে ব্যাংক চলবে। তাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত, আজ পর্যন্ত ওই গ্রামীণ ফোনের একটি টাকাও গ্রামীণ ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে কি না। দেওয়া কিন্তু হয়নি।

গ্রামীণ ব্যাংকের আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে শেখ হাসিনা বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য অনেক সময় বিদেশ থেকে অনুদান এসেছে, তার কয়টা টাকা গ্রামীণ ব্যাংকে গেছে। প্রতিটি সময় সেটা নিয়ে নতুন একটি ব্যবসা খুলে ব্যবসা করেছেন। কিন্তু কোনো ট্যাক্সই দেননি। তিনি যে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন এটা তো তিনি নিজেই প্রমাণ করেছেন। কারণ তার বিরুদ্ধে যখন মামলা হয়েছে তিনি কিছু টাকা শোধ দিয়ে বসে আছেন। যখন কিছু টাকা দিল এতে তো প্রমাণ হলো যে তিনি ট্যাক্স ফাঁকি দেন। এমনকি টেলিনর-গ্রামীণফোন সেখান থেকেও কয়েক দফায় এভাবে ট্যাক্স আদায় করা হয়েছে। ড. ইউনূসের উত্থানের পেছনে সরকারের অবদান রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা ঠিক তাকে আমরা সবাই মিলে তুলেছি। আমরা তাই খুবই প্রমোট করেছি। এটা ঠিক। এখন সব দোষ আমার! আমি তাকে সব থেকে বেশি দিলাম। এইটুকু কৃতজ্ঞতা তো থাকা দরকার। আজ তিনি যে উঠেছেন, সেখানে সব থেকে বেশি সহযোগিতা আমিই করেছিলাম। তিনি বলেন, তার (ড. ইউনূস) মাইক্রো ক্রেডিট সামিট-মাইক্রো ক্রেডিট আন্তর্জাতিকভাবে খুব বেশ গ্রহণযোগ্য ছিল না। আমি কো-চেয়ার হিসেবে অংশগ্রহণ করি। জাতিসংঘে প্রস্তাব আনি এবং আমি সবাইকে বোঝাই। কারণ আমিও ভাবতাম যে খুব ভালো, মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করে। কিন্তু ধীরে ধীরে পরবর্তীতে আমরা দেখলাম-এটা দারিদ্র্যমুক্ত নয়, এটা দারিদ্র্য লালনপালন করে। ওই মানুষগুলো দিনরাত কাজ করার পর যে উচ্চহারে সুদ দিতে হয়, বিভিন্নভাবে প্রায় ৪০-৪৫ ভাগ সুদ দিতে হতো। যশোরের যে এলাকায় হিলারি ক্লিনটনকে নিয়ে যেসব মানুষকে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়েছিল সেই পরিবারগুলো এখন কোথায়। খোঁজ করেন। দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংক তেমন কোনো ভূমিকা রাখেনি এমনটি জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে যারা ঋণ নিয়েছে জমিজমা বেচে, তারা ওখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অনেকে আত্মহত্যা করেছে এ সুদের চাপে। আমি তাকে টাকা দিয়ে বলেছিলাম, এত সুদ না নিয়ে মানুষের জন্য যেন একটু সহনশীল করে দেন। মানুষ সত্যিকার অর্থে যেন দারিদ্র্য থেকে উঠে আসতে পারে। আমার প্রশ্ন-এতই যদি করে থাকেন তাহলে দারিদ্র্য বিমোচন হলো না কেন বাংলাদেশে? দারিদ্র্য বিমোচন তো করলাম আমি। আজ ৪১ দশমিক ৬ ভাগ থেকে ১৮ দশমিক ৭ ভাগে নামিয়ে এনেছি মাত্র এই ১৫ বছরে। সে ক্রেডিটও নেয়। সেটাও কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা লিখে ফেলে, ওই গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ওই অমুকসমুক এটা করে ফেলেছে। আমার প্রশ্ন-শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগে ওই দারিদ্র্যের হার কত শতাংশ ছিল। শেখ হাসিনা আসার পর কতটা কমেছে। সেটা একটু হিসাব করে বলুন না।

নোবেল পুরস্কার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নাকি জেলাসি-নিবন্ধে এমন কথাও উঠে এসেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অনেকে নাকি লিখেছে নোবেল প্রাইজের জন্য আমার সঙ্গে নাকি দ্বন্দ্ব! আমার সঙ্গে কারও দ্বন্দ্ব নেই। জীবনেও নোবেল প্রাইজের জন্য আমার কোনো আকাক্সক্ষাও নেই। কারণ আমার লবিস্ট রাখার মতো টাকাও নাই, পয়সাও নাই। আর আমি কখনও ওটা চাইনি। পার্বত্য শান্তি চুক্তি হওয়ার পরে শুধু আমার দেশ নয়, দেশে-বিদেশে অনেক নোবেল লরিয়েট আমার জন্য লিখেছে। কই আমি তো কখনো তদবির করতে যাইনি। কারও কাছে বলতেও যাইনি। কী পেলাম না পেলাম ওইগুলো আমার মাথার মধ্যেও নেই। যিনি অর্থনীতি নিয়ে কাজ করলেন, ব্যাংকের একজন এমডি। তিনি যখন নোবেল প্রাইজ পান তার সঙ্গে আমি কনটেস্ট করতে যাব কেন? প্রধানমন্ত্রী বলেন, যদি কেউ বিদেশে আমার নামে প্রস্তাব দেয়, কই আমরা তো ছুটে যাইনি তাদের কাছে। আমার কাছে অনেকে আসছে। আমি বলেছি-না, আমার এসমস্ত পুরস্কারের দরকার নেই। আর আমি দেখছি, এ পুরস্কার যারা পায় তাদের আন্তর্জাতিকভাবে কতটুকু অবদান, সেটা নয়। এখানে আলাদা একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। কাজেই ওর মধ্যে আমার কোনো আকাক্সক্ষা নেই। আর বলে দিল, এটা নিয়ে নাকি আমি উনার ওপর জেলাসি! দৃঢ়কণ্ঠে প্রধানন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনা কারও সঙ্গে জেলাসি করে না। শেখ হাসিনা জাতির পিতার মেয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। অন্তত এ জায়গাটায় কেউ আসতে পারবে না। সেটাই আমার গর্ব। প্রধানমন্ত্রী এটা তো সাময়িক ব্যাপার। আমি শেখ মুজিবের মেয়ে। আমি দেশও বেচি না। দেশের স্বার্থও বেচি না। দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই চলি। তার জন্য আগে একবার ক্ষমতায় আসতেও পারিনি। কিন্তু আমার কিচ্ছু আসে যায় না। আমি এর-ওর কাছে ধরনা দিয়ে বেড়াই না। সব থেকে বেশি যে করেছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে বেড়াচ্ছেন। ওনার (ইউনূস) সঙ্গে আমার জেলাসির কী আছে! সে আসুক না। মাঠে আসুক। চলুক আমার সঙ্গে। আমেরিকায় ডিবেট হয় না? আসুক কথা বলব।

নিবন্ধ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সে এখন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামির জন্য এত কথা লেখে কীভাবে একজন সাংবাদিক? ওই সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করুন। মামলা করেছে তার লেবাররা। লেবাররা যখন দাবি করেছে, প্রমোশন চেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে চাকরিচ্যুত করে দিয়েছে। পরে তারা মামলা করেছে। আমি তো জানতামও না এটা। আর লেবার কোর্টের মামলায় শাস্তি পেয়েছে। তো লেবারদের কি কোনো অধিকার নেই? যারা লেবার নিয়ে এত কথা বলেন, মানবাধিকারের কথা বলেন, এত কিছু বলেন তারা কোথায় এখন? তারা চুপ কেন? তারা এ লেবারদের পাশে কি দাঁড়িয়েছেন? দাঁড়াননি। লেবারদের ন্যায্য পাওনা এখন মেরে খাচ্ছে। চুরি করে খাচ্ছে। সেটা বলেছে কখনো? তিনি বলেন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইউরোপে যে-কেউ যদি ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, সঙ্গে সঙ্গে তাকে অ্যারেস্ট করবে। তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে বিক্রি করে দেবে। এটাই তাদের নিয়ম। সেটা দেখে না। সমানে ট্যাক্সি ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবার তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদায় করতে হচ্ছে। যারা লিখেছে তারা এ অনুসন্ধানটা একটু করুক। ওয়ান ইলেভেনের পর ড. ইউনূসের রাজনৈতিক দল চালুর প্রসঙ্গ তুলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, পলিটিক্যাল পার্টি করতে চেয়েছিল সেটাও লিখেছে। ২০০৭ সালে রাজনৈতিক দল করতে গেল। তাহলে ব্যর্থ হলো কেন? সে যদি গ্রামের মানুষগুলোকে এতই দিয়ে থাকে তাহলে সেই মানুষগুলো তো তার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারা আসেনি কেন? কারণ সুদের চাপে তা মৃতপ্রায় ছিল। সেজন্য তার ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। সেখানে সে ব্যর্থ হয়েছে। সে দায়িত্বও কি আমার? আমি তো তখন জেলে। বিদেশে ড. ইউনূসের ব্যবসার মূলধন নিয়ে প্রশ্ন রেখে সরকারপ্রধান বলেন, আমার প্রশ্ন-এই যে বিদেশে এত বিনিয়োগের টাকা কোত্থেকে আসছে? কার টাকা? কীভাবে কামাই করেছেন এ টাকা? সেই জবাবটা দিক। উনার পয়সা আছে উনি লেখাচ্ছেন। উনি যদি এতই জনপ্রিয় হন তাহলে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিবৃতি দিতে হবে কেন? তার জন্য সারা পৃথিবী ঝাঁপিয়ে পড়বে। কই আমাকে তো একজনও কিছু বলল না!

সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে : ভারত সফরে দেশটির কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আমি তো বলেছি, আমার সঙ্গে ভারতের প্রত্যেকটা দল, সকলের সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। সোনিয়া গান্ধী ও তাঁর ছেলেমেয়ে এবং প্রণব মুখার্জি ও তাঁর ছেলেমেয়ের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কথাও উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইন্দিরা গান্ধীর পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটা পারিবারিক বন্ধন আছে। সেটা সব রাজনীতি, সবকিছুর ঊর্ধ্বে।

বিষধর সাপ রাসেলস ভাইপার নিয়ে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে-এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্যই জীবজন্তু। যেহেতু সাপের উপদ্রব বেড়েছে, এখন চলাফেরায় সতর্ক হতে হবে। আমি একটা বিষয়ে বিশ্বাস করি, জীবজন্তু-সাপ যা-ই বলেন, এরা কোনো দিন খামাখা কোনো মানুষকে আক্রমণ করে না, যদি না তারা ভীত হয়ে যায় বা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে থাকে। তা ছাড়া তারা কোনো দিন কারও ক্ষতি করে না। তিনি বলেন, আমরা যখন মাছ ধরতে বসি, তখন দেখি পাশ দিয়েই সাপ যাচ্ছে। একদিন দেখি আমার বসার স্থানের পাশেই একটা সাপ মুখ বের করে আছে। কই, কোনো দিন আমাকে সাপে কাটেনি তো। কোনো দিন ভয়ও পাইনি।

সর্বশেষ খবর