শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

দুর্ধর্ষ মিশন চার ফাঁসির কয়েদির

কারাগারের ছাদ ফুটো করে পালালেন, পরে গ্রেফতার একজন মেয়রের ছেলে

নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া

দুর্ধর্ষ মিশন চার ফাঁসির কয়েদির

বগুড়া জেলা কারাগারের ছাদ ফুটো করে পালিয়ে যাওয়া মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত চার কয়েদিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল ভোর ৪টার দিকে শহরের চেলোপাড়া চাষিবাজার এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দিয়াডাঙ্গার নজরুল ইসলাম মঞ্জু (৬০), নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার ফজরকান্দির আমির হোসেন (৩৮), বগুড়ার কাহালু পৌরসভার মেয়র আবদুল মান্নানের ছেলে মো. জাকারিয়া (৩১) ও বগুড়ার কুটুরবাড়ী পশ্চিমপাড়ার ফরিদ শেখ (২৮)। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা তদন্তে কারা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে কারা সদর দফতর। এ ছাড়া বগুড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ছয় সদস্যের আরও একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

জেলা পুলিশ ও কারা সূত্র জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টা ৫৬ মিনিটে বগুড়া জেলা কারাগার থেকে চারজন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত কয়েদি পালিয়ে যান। খবর পেয়ে বগুড়া সদর থানা ও ফাঁড়ি পুলিশের একাধিক দল শহরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করে। একপর্যায়ে ভোর ৪টা ১০ মিনিটে সদর ফাঁড়ির এসআই খোরশেদ আলম শহরের চেলোপাড়া করতোয়া নদীর পাড়ে চাষিবাজার থেকে ওই চারজনকে গ্রেফতার করেন। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, পৃথক মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এ চার কয়েদি একই কনডেম সেলে ছিলেন। সেখান থেকে তারা পালানোর পরিকল্পনা করেন। ঘটনার রাতে তারা নিজেদের বিছানার চাদর ছিঁড়ে দড়ি তৈরি করেন। এরপর কৌশলে কারাগারের ছাদ ফুটো করে সেলের বাইরে বের হন। আগে থেকে বিছানার চাদর দিয়ে বানানো দড়ি দিয়ে কারাগারের বিল্ডিং থেকে নিচে নামেন। এরপর পালিয়ে যান। এ ঘটনা জানামাত্র দ্রুততম সময়ে পুলিশ সদস্যরা চার কয়েদিকে আটক করতে সক্ষম হন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।

বগুড়া কারাগার সূত্রে জানা যায়, এ চারজনের মধ্যে কুড়িগ্রামের নজরুল ইসলাম মঞ্জু (কয়েদি নম্বর ৯৯৮) ও নরসিংদীর আমির হোসেন (কয়েদি নম্বর ৫১০৫) একই পরিবারের চারজনকে হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত। ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ভূরুঙ্গামারীর দিয়াডাঙ্গা গ্রামের সুলতান মন্ডল, তাঁর নাতনি রোমানা, আনিকা ও স্ত্রী হাজেরাকে কুপিয়ে খুন করে একদল মুখোশধারী। পরে সুলতান মন্ডলের ছেলে বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ছয়জনকে মৃত্যুদন্ড দেন আদালত। সেই ছয়জনের দুজন নজরুল ও আমির।

বগুড়ার মো. জাকারিয়া (কয়েদি নম্বর ৩৬৮৫)সহ কয়েকজন কাহালু উপজেলার রুমচাপড় গ্রামের রফিকুল ইসলাম তালুকদারের ছেলে শিশু নাঈমুল ইসলাম নাঈমকে (১৩) ২০১২ সালের ৫ এপ্রিল স্কুলে যাওয়ার পথে কাহালুর চারমাথা এলাকা থেকে অপহরণ করে একটি দোকানঘরে আটকে রেখে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। টাকা না পেয়ে ওইদিন বিকালে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। এরপর লাশ বস্তায় ভরে জাকারিয়া তার বাবা মান্নানের ইটভাটার জ্বলন্ত চিমনির মধ্যে ফেলে দেন। এ ঘটনায় নাঈমের বাবা কাহালু থানায় জাকারিয়াসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে পুলিশ ভাটা থেকে কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করে। ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি এ হত্যা মামলায় দুজনকে মৃত্যুদন্ড দেন আদালত। তার একজন জাকারিয়া।

২০১৯ সালের ১৯ জুন বগুড়া সদরের কুটুরবাড়ী গ্রামের ইয়াকুব আলী ও বাদশা শেখের পরিবারের মধ্যে ছাগলে ভাত খাওয়া নিয়ে ঝগড়া হয়। পরদিন দুপুর দেড়টার দিকে বাড়ির পাশে শিশুদের ফুটবল খেলা দেখছিলেন বাদশা শেখের ভাই রফিকুল ইসলাম। এ সময় ইয়াকুবের পরিবারের মোহাম্মদ নয়ন নামে এক যুবক রফিকুলকে মারধর করেন। খবর পেয়ে রফিকুলের পরিবারের সদস্যরা ইয়াকুবের পরিবারের কাছে নালিশ নিয়ে যান। এ সময় দুই পক্ষে তুমুল ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে বাদশা শেখের ছেলে আল আমিনের পাঁজরে বল্লম ঢুকিয়ে দেন ইয়াকুব আলীর পরিবারের লোকজন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আল আমিন মারা যান। পরে আল আমিনের বাবা বাদী হয়ে সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। সে মামলায় সিআইডি ২০২০ সালের ৩০ জুলাই ১১ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর আদালত একজনকে মৃত্যুদন্ড, সাতজনকে যাবজ্জীবন ও তিনজনকে খালাস প্রদান করে রায় ঘোষণা করেন। সেই ফাঁসির আসামি ফরিদ শেখ (কয়েদি নম্বর ৪২৫২)। বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বগুড়া জেলা কারাগার অনেক পুরনো। এটি ব্রিটিশ আমলে তৈরি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা গেছে ভবনের অনেক স্থান নাজুক। ওই চার আসামিকে এ বছরের ১ জুন এখানে নিয়ে আসা হয়। তাদের রাখা হয়েছিল একই সেলে। আজ (বুধবার) পরিদর্শন করে দেখা গেছে তারা ছাদের যে অংশ ফুটো করেছেন সেখানে কোনো রড ছিল না। তারা ছাদে গামছা বেঁধে ছাদ ফুটো করেন। যেদিক দিয়ে তারা পালিয়েছিলেন সেখানে নিরাপত্তাচৌকি স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটি : আসামি পালানোর ঘটনায় বগুড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পি এম ইমরুল কায়েস। কমিটিতে জেলা পুলিশ, গণপূর্ত অধিদফতর ও জেলা কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। কারা সদর দফতরের তিন সদস্যের কমিটির সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান, উপমহাপরিদর্শক (সদর) মনিরুল ইসলাম ও রংপুর জেলা কারাগারের সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক। কারা সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটি আগামীকাল কাজ শুরু করবে।

সর্বশেষ খবর