শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

গরু মাফিয়া সাম্রাজ্যের পতন

গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো সাদিক অ্যাগ্রোর দুই স্থাপনা ♦ কোরবানির বাজারে গরু-ছাগলের দামে ছিল সীমাহীন বাড়াবাড়ি ♦ প্রতিষ্ঠান নয়, অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান : ম্যাজিস্ট্রেট

নিজস্ব প্রতিবেদক

গরু মাফিয়া সাম্রাজ্যের পতন

মোহাম্মদপুরের বছিলায় আলোচিত ইমরানের মালিকানাধীন সাদিক অ্যাগ্রোর খামার গুঁড়িয়ে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন -রোহেত রাজীব

ছাগলকান্ডে বেরিয়ে আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের হাঁড়ির খবর। হারান এনবিআরের পদ, সরে যেতে হয় সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকেও। এবার ছাগলের রশির প্যাঁচে পড়েছে ‘সাদিক অ্যাগ্রো’ খামারও। এরই মধ্যে গণমাধ্যমের খবরে অভিযোগ উঠে এসেছে, সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক শাহ ইমরান হোসেন মূলত খামারের আড়ালে একজন গরু চোরাচালানকারী। তিনি ও তার সিন্ডিকেট ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চোরাই পথে নানা জাতের গরু নিয়ে আসেন দেশে।

এরপর সেগুলো চড়া দামে বিক্রি করেন। কোরবানির বাজারে গরু-ছাগলের দামেও সীমাহীন বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। এর পরই অভিযোগ ওঠে মোহাম্মদপুরের বছিলায় খালের জমি দখল করে খামার নির্মাণ করে সাদিক অ্যাগ্রো। এ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে গতকাল অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। অভিযানে সাদিক অ্যাগ্রোর দুই স্থাপনা উচ্ছেদ করে মালামাল নিলামে বিক্রি করা হয়। এ অভিযানে পতন ঘটল গরু মাফিয়া সাম্রাজ্যের। মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ হাউজিং ও নবীনগর হাউজিংয়ে গতকাল উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেন ডিএনসিসি অঞ্চল-৫-এর নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতাকাব্বির আহমেদ। গতকাল রামচন্দ্র খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের খবর পেয়ে সকাল থেকে টিনের ঘর, রিকশা গ্যারেজসহ বিভিন্ন স্থাপনা সরিয়ে নিতে থাকে লোকজন। এ সময় তারা বলেন, ঘর ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল তাদের কাছ থেকে আদায় করতেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। সকাল ১০টায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ডিএনসিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন দুপুর ১২টায়। পরে কাগজপত্র অনুযায়ী সাদিক অ্যাগ্রোর অফিস ও ছাগলের খামার উচ্ছেদ শুরু হয়। ভবনটির নিচতলায় সাদিক অ্যাগ্রোর অফিস, গরু-ছাগলের খামার। আর দ্বিতীয় তলায় মালিকরা থাকেন। অভিযানে প্রথমে সাদিক অ্যাগ্রোর অফিস গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর খামারে থাকা ছাগল সরানোর জন্য কিছু সময় দিয়ে আবার অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে গরু-ছাগলের খামারসহ দুই তলা ভবনটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। যদিও অভিযানের খবর শুনে বুধবার রাতে খামার থেকে গরু সরিয়ে ফেলে সাদিক অ্যাগ্রো।

এ খামারের অবৈধ অংশ উচ্ছেদের সময় মালিককে দেখা যায়নি। উচ্ছেদের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কোনো কর্তাব্যক্তি কথা বলেননি। কিন্তু খামারের একাধিক কর্মচারী বলেন, এ জায়গা সাদিক অ্যাগ্রোর সম্পত্তি না। মালিক এটি ভাড়া নিয়েছেন। এ ছাড়া সাদিক অ্যাগ্রোর পেছনে থাকা রিকশা গ্যারেজ ও ঘর বুলডোজার দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে দেন উচ্ছেদ অভিযানের কর্মীরা। স্থানীয়রা জানান, শুরুতে ছোট আকারে একটি খামার করেছিল সাদিক অ্যাগ্রো। পরে সেটিকে দিনে দিনে বড় করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমে ব্যক্তিমালিকানা জায়গায় থাকলেও পরে বাড়িয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও খালের বিপুল পরিমাণ জায়গা দখল করে ছাউনি তৈরি করে। লোহার বেড়া দিয়ে তৈরি ছাউনিতে রাখা হয় গরু, ছাগল, দুম্বা, উট। একই খামারে বর্তমানে দুগ্ধ এবং বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করা হয়। যার দামও সাধারণ মানুষের নাগালের বেশ বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, সাদিক অ্যাগ্রো কোরবানির বাজারে গরু-ছাগলের দামেও সীমাহীন বাড়াবাড়ি করেছে। কোনো কোনো গরুর দাম হাঁকিয়েছেন কয়েক গুণ বেশি। একই অবস্থা ছাগলেও। ওজন অনুযায়ী ছাগলের দাম কয়েক গুণ বেশি চাওয়া হয়েছে। ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রিও করেছে গরু-ছাগল। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধসংলগ্ন নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর অন্য খামারটিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। উচ্ছেদ শেষে মালামাল নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোতাকাব্বির আহমেদ বলেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শেষে জব্দ মালামাল উন্মুক্ত নিলামে বিক্রি করা হয়। নিলামে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ৬৭ হাজার ৫০০ টাকায় সব মালামাল কিনে নিয়েছেন। তাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিলামে কেনা মালামাল সরিয়ে নিতে বলা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরও বলেন, ‘খালের একটা নীতিমালা আছে। খালের ৩০ ফিট আশপাশে কোনো স্থাপনা থাকতে পারবে না। জমির মালিক কাগজ দেখিয়েছেন ৪ শতাংশের কিন্তু দখল করেছেন ১ বিঘা। আর আমরা উচ্ছেদ করেছি অবৈধ স্থাপনা, জমির মালিককে না। খালের ভিতরের যে অংশ আছে সেটা আমরা উচ্ছেদ করেছি।’ উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর সাদিক অ্যাগ্রোর খামার গুঁড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। অভিযানে নেতৃত্ব দেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব কবির বিন আনোয়ার। তবে সে উচ্ছেদের পর এক বছরও দখলমুক্ত ছিল না জায়গাটি। খাল দখল করে পুনরায় নির্মাণ করা হয় টিনশেড। মেঝে করা হয় ঢালাই।

সর্বশেষ খবর