শিরোনাম
শনিবার, ২৯ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

অবিশ্বাসের দোলাচলে বিএনপি

অসুস্থ খালেদা জিয়া ♦ বিদেশে তারেক রহমান ♦ আলোচনায় কমিটি পুনর্গঠন সম্মেলন ও তরুণ নেতৃত্ব

শফিউল আলম দোলন

অবিশ্বাসের দোলাচলে বিএনপি

সর্বত্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে চলছে দলটি। কমিটি পুনর্গঠনসহ আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত বিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। মূল কমিটি ছাড়াও ছাত্রদলসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। সম্প্রতি ছাত্রদলের পদবঞ্চিত একটি গ্রুপ রাজধানীর নয়াপল্টনে দফায় দফায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। সৃষ্টি করেছে ব্যাপক আতঙ্কের। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

তার মধ্যেই বিএনপি চেয়ারপারসনের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আজ শনিবার রাজধানী ঢাকায় এবং ১ ও ৩ জুলাই সারা দেশে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। কমিটি পুনর্গঠন এবং কেন্দ্রীয় কাউন্সিল/সম্মেলন নিয়েও আলোচনা চলছে। সারা দেশে কমিটি পুনর্গঠনের পর আয়োজন করা হবে জাতীয় কাউন্সিলের। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় বিএনপিতে বড় ধরনের রদবদল করা হয়েছে। অচিরেই আরও দুই দফা রদবদলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে কেন্দ্রীয় এবং মহানগর বিএনপির নেতাদের সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগত ভূমিকা যাচাই ও মূল্যায়নের মাধ্যমেই কমিটিতে পদায়ন করছেন হাইকমান্ড। এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন তিনি। তবে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে পরিবর্তন জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমেও আসতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, অন্তর্দ্বন্দ্ব আর কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা। বিশেষ করে ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর এবং ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে গ্রেফতারকৃত নেতাদের সন্দেহ করছেন কারাগারের বাইরে থাকা নেতারা। এর মধ্যে ১৯ জন শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে দলের স্বার্থবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন তারা। অন্যদিকে যারা কারাগারের বাইরে ছিলেন কিংবা গ্রেফতার এড়াতে দেশে-বিদেশে গাঢাকা দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ তুলছেন কারা-নির্যাতিত নেতারা। ফলে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এ নিয়ে অঘোষিত বিভক্তির রেখা ফুটে উঠেছে। এসব সন্দেহ-অবিশ্বাসের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দলীয় হাইকমান্ড পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এখনো পর্যন্ত কোনো পক্ষের বিরুদ্ধেই এসব অভিযোগের ‘অকাট্য’ প্রমাণ না পেলেও অভিযোগগুলো নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এদিকে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে অবস্থান করছেন। অর্থাৎ দলের শীর্ষ দুই কর্ণধারই দলের রাজনীতিতে সশরীরে অনুপস্থিত। এ সুযোগে নেতা-কর্মীদের একটি স্বার্থান্বেষী গ্রুপ তাদের নাম ভাঙিয়েও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতার অভিযোগ, সাম্প্রতিক পুনর্গঠন কান্ডে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আঞ্চলিক ত্যাগী নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। তারা বলেন, দলের জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক আলোচিত নেতাকে ‘ওএসডি’ করে রাখা হয়েছে। দলকে দুর্বল করার জন্যই এসব পরীক্ষিত নেতাকে সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। বিশেষ করে দলের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হারুন উর রশীদ ও ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকনকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করার মাধ্যমে সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে রাজশাহীর সাবেক মেয়র ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, বরিশালের সাবেক মেয়র ও সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারকে গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। একই সঙ্গে খুলনার সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনায়ও পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশির ভাগ নেতা-কর্মীর মাঝে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

দল পুনর্গঠন কার্যক্রম সম্পর্কে বিএনপি স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কমিটি পুনর্গঠনের কাজটা হচ্ছে একটা চলমান প্রক্রিয়া। সেটা কখন করবে তা একান্তই দলের সিদ্ধান্ত। তবে আগে হোক বা পরে হোক এই পুনর্গঠন করতেই হবে। আর কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সবাই যে খুশি হবে- সেটিও ঠিক নয়। এখন যারা বঞ্চিত হচ্ছেন- কিছুদিন পরে দেখা গেল- তাদেরও পদায়ন করা হয়েছে। তখন আবার আরেকটা পক্ষ অখুশি হবে। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এ নিয়ে অস্থির হওয়ার কিছু নেই।

গত বছরের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ প- হওয়ার পর সারা দেশে দলের ২৭ হাজার সক্রিয় নেতা গ্রেফতারের শিকার হন। কেরানীগঞ্জ ও গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারেই বেশির ভাগ নেতা বন্দি ছিলেন। নির্বাচনের পর পর্যায়ক্রমে তারা জামিনে মুক্ত হন। আবার শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনেকে আন্দোলন চলাকালে পুলিশি অভিযানের সময় গ্রেফতার এড়াতে কেউ প্রকাশ্যে, আবার কেউ আত্মগোপনে ছিলেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপের ঘটনা ঘটছে।

এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বড় রাজনৈতিক দলের ভিতরে এরকম একটু-আধটু রাগ-গোস্বার ঘটনা ঘটেই থাকে। এসব কিছুদিন পরে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। এটা কোনো কোন্দল বা বিরোধ নয়। এটাকে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা বলা যেতে পারে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন করছেন।

সম্প্রতি দলের যুগ্ম মহাসচিব পদ থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো এবং কারা-নির্যাতিত এক সিনিয়র নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কারাগারে থাকা বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দলের কতিপয় নেতা তুলছেন, তা সঠিক নয়। বরং তারা এসব ভুয়া অভিযোগ এনে দলের হাইকমান্ডকে সরকারের সঙ্গে নিজেদের আঁতাতের ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করছেন। যেখানে বিএনপির অনেক সক্রিয় নেতা-কর্মী আত্মগোপন করেও গ্রেফতার এড়াতে পারেননি, সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের চোখে দেখেনি। এতেই প্রমাণ হয়, তারাই ভিতরে ভিতরে সরকারের সঙ্গে আঁতাত করেছেন। আন্দোলনকে ব্যর্থ করতে ষড়যন্ত্র করেছেন।

এসব বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপি মহাসাগরের মতো বিস্তৃত একটি বিশাল রাজনৈতিক দল। এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। নেতাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতামত প্রদানের ক্ষেত্রেও পার্থক্য থাকতেই পারে। তবে কোনো রকমের অভ্যন্তরীণ বিরোধ বা কোন্দল নেই। তবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে কত চেষ্টা করেছে এ সরকার, কিন্তু দুই-একটা ছিটেফোঁটা ছাড়া কাউকে দলচ্যুত করতে পারেনি।

সর্বশেষ খবর