শিরোনাম
শনিবার, ২৯ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

মতিউরের স্ত্রী লায়লা সম্পদ রক্ষায় মরিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক

মতিউরের স্ত্রী লায়লা সম্পদ রক্ষায় মরিয়া

পরিবারের দুর্নীতির অভিযোগ ধামাচাপা দিতে ‘টাকা দিয়ে’ সব ম্যানেজ করতে চান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ। গত বুধবার তিনি উজান-ভাটি রেস্টুরেন্টে বৈঠক করেন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের নিয়ে। পরদিন বৃহস্পতিবার যোগ দেন উপজেলা পরিষদ বৈঠকে। এর আগে সাক্ষাৎ করেন একজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে। যোগাযোগ করছেন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে। তবে মতিউর কোথায় বলছেন না কাউকে। নিজের ধনসম্পদ রক্ষায় এখন তিনি মরিয়া। লায়লার হঠাৎ বেপরোয়া অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কার ক্ষমতায় লায়লা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছেন না?

১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনার কান্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর ‘কেঁচো খুঁড়তে কেউটে সাপের’ মতো একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে মতিউর রহমানের। সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে। তার নামে প্রায় ২৮ বিঘা জমি ও ৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে; এর মধ্যে ঢাকার মিরপুরে একটি ভবনেই রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। কলেজশিক্ষক লায়লা কানিজ বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক।

তবে নির্বাচনের আগে লায়লা কানিজ নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় নিজের নামে ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, যশোর ও নাটোরে মোট ৮৪৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ (২৫ দশমিক ৭০ বিঘা) জমি থাকার কথা বলেছেন। ফ্ল্যাটের হিসাব দিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার মিরপুরের মাজার রোডের এক ভবনেই চারটি ফ্ল্যাটের নম্বর উল্লেখ করেছেন। যার মূল্য দেখিয়েছেন ১ কোটি ৬১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। যদিও ওই ভবনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে জানা গেছে, ভবনটির একেকটি তলায় চারটি করে অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। একেকটির আয়তন ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ বর্গফুট। নির্মাণের শুরু থেকে হস্তান্তর পর্যন্ত প্রতি বর্গফুট সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। সর্বনিম্ন ধরলেও এ চারটির দাম পড়ে অন্তত ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর বাইরে আরও একটি ফ্ল্যাট থাকার কথা হলফনামায় উল্লেখ থাকলেও ঠিকানা দেওয়া হয়নি। তবে সেটার মূল্য দেখানো হয় সাড়ে ৫৫ লাখ টাকা। তিনি একটি মৎস্য খামারের মালিক বলেও উল্লেখ করেছেন। মৎস্য খামার থেকে তিনি বছরে আয় করেন ১৫ লাখ ৬৯ হাজার ৩৪০ টাকা। তার ব্যাংকে জমা ছিল ৩ কোটি ৫৫ লাখ ৩ হাজার ২৪১ টাকা। তাছাড়া আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড এসপি লিমিটেডে ২০ হাজার টাকার শেয়ার এবং আইসিবি, এওএল মামুন অ্যাগ্রোতে ৮ লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে। তার কাছে স্বর্ণ রয়েছে ৩০ তোলা, যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকা। এ ছাড়া ফ্রিজ, টিভি, ফ্যান ও মোবাইল বাবদ দেখানো হয়েছে ৩ লাখ টাকা। আসবাবপত্র রয়েছে ৭৫ হাজার টাকার।

আয়ের খাত হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, কৃষি খাত থেকে বছরে ১৮ লাখ টাকা, বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। শেয়ার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা, উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে পাওয়া সম্মানি ভাতা বছরে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত সুদ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা। লায়লা কানিজ মোট যে জমির হিসাব দিয়েছেন, তার মধ্যে কেবল পাঁচ জেলার ১৩টি অকৃষি জমির অর্জনকালীন দাম দেখিয়েছেন ৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা। বাকি ৯টি অকৃষি এবং কৃষি জমিগুলোর দাম উল্লেখ করেননি।

ছেলের বিলাসী জীবনযাপনের সূত্র ধরেই মতিউরের সম্পদের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপর মতিউর রহমান ও তার পরিবারের কাউকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। ঈদের পর কর্মস্থলেও যাননি তিনি। গত রবিবার মতিউর রহমানকে এনবিআর থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। একই দিন মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করার কথা জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হলফনামার বাইরে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মরজাল মৌজার চারটি দাগে লায়লা কানিজের নামে আরও দুই বিঘা (৬৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ) জমির সন্ধান পাওয়া গেছে ভূমি অফিসের নথি থেকে। এ ছাড়া গাজীপুরের পুবাইলে ‘আপন ভুবন’ নামে বিনোদন পার্ক ও পিকনিক স্পট রয়েছে লায়লার মালিকানায়। লায়লা ও তার ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে শূন্য দশমিক ৪৫১৬২৫ একর জমি রয়েছে সেখানে। পুবাইলের গ্লোবাল শুজ লিমিটেড কোম্পানির অংশীদার হিসেবে নাম রয়েছে লায়লার। ওই কোম্পানির নামে জোত ১২৫-এ ৩৪৩৪৫ শতক, জোত ৭০-এ ২৮০০ শতক, জোত ৯০-এ শূন্য দশমিক ০৩৩০ শতক জমি রয়েছে।

২০২৩-২৪ করবর্ষের আয়কর বিবরণীতে লায়লা কানিজ তার মোট সম্পদ দেখিয়েছেন ১০ কোটি ৩০ লাখ ৫১ হাজার টাকার। তার হাতে এবং ব্যাংকে নগদ ৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা আছে বলে উল্লেখ করেছেন। পুঁজিবাজারের শেয়ার বিক্রি থেকে ১ কোটি ৬৮ লাখ ৯৩ হাজার টাকা মুনাফার কথাও উল্লেখ করেছেন। নির্বাচনের হলফনামায় লায়লা কানিজ তার পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ব্যবসা। নিয়মানুযায়ী, হলফনামায় প্রার্থীর স্বামী বা স্ত্রীর সম্পদের বিবরণও দিতে হয়। কিন্তু লায়লা কানিজ স্বামীর নাম উল্লেখ না করে বাবার নাম উল্লেখ করেছেন।

জানা গেছে, লায়লা কানিজ ছিলেন রাজধানীর তিতুমীর সরকারি কলেজের বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক। বাবা কফিল উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন খাদ্য কর্মকর্তা। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে লায়লা কানিজ সবার বড়। তিনি রায়পুরা উপজেলার মরজালে নিজ এলাকায় প্রায় দেড় একর জমিতে ‘ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট’ নামের একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। সরকারি কলেজের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন, সেই প্রশ্নও এখন সামনে এসেছে।

সর্বশেষ খবর