মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
চলছে সিআইডির অনুসন্ধান

শেয়ার কেলেঙ্কারিতেও মতিউরের নাম

মাহবুব মমতাজী

শেয়ার কেলেঙ্কারিতেও মতিউরের নাম

নামসর্বস্ব কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হস্তান্তরের ঘটনায় চট্টগ্রাম আদালতে করা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির বিষয়টি নজরে আসে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরপর বিষয়টি জানিয়ে গত বছর সরকারের উচ্চপর্যায় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে বিশেষ প্রতিবেদন দেন সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। দুদক ও সিআইডিতে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে বিশেষ প্রতিবেদনটির আদ্যোপান্ত জানা যায়। ওই বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, মতিউর রহমান বিসিএস ১১ ব্যাচের কর্মকর্তা। ট্রেড ক্যাডার থেকে পরবর্তীতে কাস্টমস ক্যাডারে ন্যস্ত হন। মো. মোর্শেদ ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের ফ্যামিলিটেক্স (বিডি) লিমিটেড, সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল লিমিটেড এবং ইফকো গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড নামে তিনটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান ছিল। মতিউর রহমান ও মোর্শেদ সংঘবদ্ধভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশে ২০১৩ সালে ফ্যামিলিটেক্স (বিডি) লিমিটেডকে প্রাইভেট কোম্পানি থেকে পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তর করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করেন। মতিউর এখানে নেছার উদ্দিন সোহাগকে ফ্যামিলিটেক্স (বিডি) লিমিটেডের পরিচালক ও ব্যাংক হিসাবের সিগনেটরি করেন। ২০১৫ সালে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল লিমিটেডকে প্রাইভেট লিমিটেড থেকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করা হয়। মতিউর এ কোম্পানিতে নেছার উদ্দিন সোহাগের স্ত্রীকে পরিচালক করেন এবং নিজে ব্যাংক হিসাবের নমিনেটেড সিগনেটরি হয়ে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করেন। এরপর ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই একটি এফিডেভিটের মাধ্যমে ইফকো গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেডের শেয়ার হোল্ডার নাজমুল শাখাওয়াত হোসেনের ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ১৪ লাখ শেয়ার মতিউরের ভাই নুরুল হুদার নামে হস্তান্তর করা হয়। পরে ফরম-১২ সংশোধন করে তাকে ওই কোম্পানির পরিচালক বানিয়ে প্রাইভেট থেকে পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তরের চেষ্টা করেন মতিউর। কিন্তু ঋণ সংক্রান্ত জটিলতা, ব্যাংকের আপত্তি ও সিআইবি রিপোর্ট পক্ষে না থাকায় পাবলিক কোম্পানিতে আর রূপান্তর করতে পারেননি। পরে জানা গেছে, নেছার উদ্দিন সোহাগ সম্পর্কে মতিউর রহমানের ফুফাতো ভাই। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে। এ ঘটনায় তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, মতিউর তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে প্রাইভেট থেকে পাবলিকে রূপান্তর করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতেন। পরে কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

যে ভাবে বেরিয়ে আসে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনা : ২০২০ সালে চট্টগ্রাম আদালতে একটি মামলা করেন মতিউর রহমানের ভাই নুরুল হুদা। ওই বছরের ১২ অক্টোবর আদালত মামলাটির তদন্ত সিআইডিতে ন্যস্ত করে। পাঁচজন তদন্ত কর্মকর্তাকে পরিবর্তন করে সর্বশেষ মামলাটির তদন্ত করেন পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। এ মামলায় বিবাদী করা হয় জনৈক মো. মোর্শেদ ও একজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে। এ মামলার অনুসন্ধান প্রতিবেদনের একটি কপি এ প্রতিবেদকের কাছে আছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এবং ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি জাল-জালিয়াতি করে ব্যাংকের এনওসি বানানো হয়। ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই এবং ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর জাল-জালিয়াতি করে শেয়ার হস্তান্তরের নথি তৈরি করা হয়। এ ছাড়া ঢাকার নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে ভুয়া হলফনামা তৈরি করে তা রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে ব্যবহার করা হয়। নুরুল হুদা তার মামলায় বলেছেন, ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি একটি ব্যাংক থেকে লিগ্যাল নোটিস পান। ওই নোটিসে জানতে পারেন তিনি ইফকো গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইলের পরিচালক হিসেবে ওই প্রতিষ্ঠানের নেওয়া বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের জন্য দায়বদ্ধ এবং তা পরিশোধে ব্যর্থ হলে ব্যাংক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তিনি ইফকো গার্মেন্টসের পরিচালক হিসেবে ১০টি ফৌজদারি ও ১টি দেওয়ানি মামলার বিবাদী।

নুরুল হুদা জানান, তিনি কীভাবে ইফকো গার্মেন্টসের পরিচালক হলেন, এর তথ্য খুঁজতে গিয়ে জানতে পারেন পরিকল্পিতভাবে ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই তার নাম-ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্যাদি সংগ্রহ করে নাজমুল শাখাওয়াত হোসেনের ১ কোটি ৪০ লাখ টাকার শেয়ার তার নামে হস্তান্তর দেখানো হয়। এরপর তার স্বাক্ষর জাল করে ডুকমেন্ট তৈরি করা হয়। সিআইডি সূত্র বলছে, নুরুল হুদার নামে স্বাক্ষর করতেন তার আপন বড় ভাই এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান। নুরুল হুদার নাম ব্যবহার করে ভুয়া বোর্ড মিটিং, কোম্পানি থেকে ইস্তফা, হলফনামা তৈরি, ভুয়া রেজুলেশন এবং শেয়ার হস্তান্তরে নানা জাল-জালিয়াতি করা হয়েছে। এই জাল-জালিয়াতির আরও গভীরে গিয়ে শেয়ার বাজারে কারসাজিতে মতিউরের সম্পৃক্ততার বিষয়টি খুঁজে পান পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।

 

সর্বশেষ খবর