বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

তলিয়েছে ঘরবাড়ি সড়ক

বন্যায় চারজনের মৃত্যু, সিলেটে ভোগান্তিতে ৭ লাখ মানুষ

প্রতিদিন ডেস্ক

তলিয়েছে ঘরবাড়ি সড়ক

সিলেটের গোয়াইনঘাটে সড়ক তলিয়ে যোগাযোগ ব্যাহত -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ি ঢল এবং ভারী বৃষ্টিপাতে নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে বন্যার পানির তীব্র স্রোতে নৌকাডুবির ঘটনায় সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে মা-মেয়েসহ তিনজন নিখোঁজ হয়েছেন। বন্যার ভয়াবহতার কারণে অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে ফেনীর মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের তিনটি স্থান ভেঙে ৪ গ্রাম প্লাবিত এবং এ ঘটনায় একজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া শেরপুরে পাহাড়ি ঢলে তিন উপজেলায় বাঁধ ভেঙে অন্তত ৬০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সিলেটে তৃতীয় দফার এই বন্যার কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাত লক্ষাধিক মানুষ। এদিকে তিস্তা ও যমুনা নদীর পানি বাড়ায় তীরবর্তী জেলাগুলোতে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য।

সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার আজমপুর গুচ্ছগ্রাম সংলগ্ন সুরমা নদী পারাপারের সময় গতকাল ডিঙি নৌকা ডুবে মা-মেয়েসহ তিনজন নিখোঁজ হয়েছেন। তারা হলেন- আজমপুর গুচ্ছগ্রাম এলাকার নূর আলীর স্ত্রী গুলু বিবি (৭০), আইন উদ্দিন জোছনা (৩৫) এবং তার শিশুকন্যা হামজা (২)। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার দিকে ডিঙ্গি নৌকাযোগে সাতজন যাত্রী গুচ্ছগ্রাম থেকে সুরমা নদী পার হয়ে দোয়ারাবাজার উপজেলা সদরে যাচ্ছিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর নদীর প্রবল স্রোতে নৌকাটি উল্টে যায়। নৌকাতে থাকা সাত যাত্রীর মধ্যে  তিনজন সাঁতরে পাড়ে উঠলেও এক নারী নারী ও তার শিশুকন্যা এবং অপর এক বৃদ্ধা পানিতে তলিয়ে যান।

সুনামগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন মাস্টার আবদুল হান্নান জানান, স্থানীয়দের সহায়তায় ফায়ার সার্ভিস নদীতে উদ্ধার অভিযান চালায়। কিন্তু প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হয়। তিন ঘণ্টার অভিযানে নিখোঁজের উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে ভারী বর্ষণ আর ভারতের পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে আবারও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্লাবিত হয়েছে জেলার তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, সদর, দোয়ারাবাজার ও ছাতক উপজেলার বিভিন্ন এলাকা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ।

এদিকে সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের আনোয়ারপুর, শক্তিয়ারখলা ও দুর্গাপুর এলাকায় পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে তাহিরপুর, মধ্যনগর ও ধর্মপাশা উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। একই পরিস্থিতি রয়েছে ছাতক-সুনামগঞ্জ সড়কেও। ভোগান্তি পোহাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। নৌকাযোগে চলাচল করছেন তারা।

ফেনী : প্রবল বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মুহুরী নদীর তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে ফেনীর ফুলগাজী এবং পরশুরামের চার গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সোমবার রাত ১১টার দিকে পরশুরামের দক্ষিণ শালধর গ্রামে, ফুলগাজী উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে নদীর কিসমত ঘনিয়ামোড়া এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে অন্তত চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার গতকাল এইচএসসি ও আলীম পরীক্ষা স্থগিত থাকে। সোমবার রাতে ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের পূর্ব ঘনিয়ামোড়া এলাকায় কহুয়া নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে মো. মামুন (২২) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত মামুন কিসমত ঘনিয়ামোড়া এলাকার আবদুল মান্নানের ছেলে। ব্রিজের ওপর থেকে মাছ ধরতে গিয়ে পা পিছলে মামুন নদীতে পড়ে মারা যায়।

এদিকে দুপুরে নদীর ভাঙন স্থান পরিদর্শনে করেছেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এমপি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী নাসিম।

সিলেট : এক মাসে তিন দফা বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট। বর্তমানে জেলার ৭ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। মহানগরের বিভিন্ন স্থানেও রয়েছে জলাবদ্ধতা। ফলে মাসেরও অধিক সময় ধরে টানা ভোগান্তিতে আছেন লাখ লাখ মানুষ। তৃতীয় দফা বন্যায় দিশেহারা হয়ে মানুষ ছুটছেন সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র ও নিরাপদ স্থানে। এদিকে জেলা বিএনপির উদ্যোগে এবং জেলা বিএনপির উপদেষ্টা হেলাল উদ্দিনের সহযোগিতায় গোয়াইনঘাট উপজেলা সদর ও আলীরগাঁও ইউনিয়নের আনন্দবাজারে তিন শতাধিক পরিবারের মধ্যে খাদ্যসহায়তা ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়। এ সময় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী।

শেরপুর : কয়েক দিনে অবিরাম ভারী বর্ষণে এবং সীমান্তবর্তী  ভারতের মেঘালয় ও আসামের  পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে ঝিনাইগাতীর মহারশি নদীর পানি  বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেরপুরের নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদীর খালভাঙ্গা ও শ্রীবরদী উপজেলার সোমেশ্বরী নদীতেও ব্যাপকভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়ে এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এই তিন উপজেলার অন্তত ৬০টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

রংপুর : ভারী বৃষ্টিপাত এবং উজানের ঢলে কাউনিয়া উপজেলায় তিস্তা ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে নদী পাড়ের মানুষ। তিস্তা নদী বেষ্টিত কাউনিয়া উপজেলার গদাই এলাকার কয়েক শতাধিক পরিবার ভাঙনঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া চর এলাকায় কয়েক শ পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

গাইবান্ধা : ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়ার নদীর পানি বেড়েই চলেছে। ফলে এসব নদ-নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারও মানুষ। এদিকে তিস্তা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তিস্তার পানি কমে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

লালমনিরহাট : জেলার ৫ উপজেলার নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও তিস্তার চরাঞ্চল থেকে পানি নামতে শুরু করছে। তবে চলাচলের রাস্তাঘাট ও গবাদিপশু নিয়ে ভোগান্তির শেষ নেই। গতকাল দুপুর ১২টায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানিপ্রবাহ বিপৎসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে তিস্তা রেলসেতু পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম : তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার কমে এখন বিপৎসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া দুধকুমার নদের পাটেশ্বরী পয়েন্টে পানি ১১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে ও ধরলা নদীর শিমুলবাড়ী পয়েন্টে পানি ১২ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে ধরলা নদীর অপর সেতু পয়েন্টেও পানি ২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ফের দ্রুত বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধ হার্ড পয়েন্টে ৩৪ সে.মি পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে। অন্যদিকে পানি বাড়ায় যমুনার চরাঞ্চল ও অরক্ষিত অঞ্চলে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে।

নেত্রকোনা : পাহাড়ি ঢলে দ্রুতগতিতে বাড়ছে নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার উব্দাখালী নদীর পানি। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সোমেশ্বরী, কংশ ও ধনু নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত সোমবার দুপুর থেকে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে উব্দাখালী নদীর পানি। ফলে নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল আবারও প্লাবিত হয়েছে।

নোয়াখালী : টানা বৃষ্টিতে নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীর বিভিন্ন সড়কে হাঁটু পরিমাণ পানি উঠে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন দোকানপাট ও অফিস আদালতে ঢুকে গেছে পানি। এদিকে  স্কুল ও কলেজগামী  শিক্ষার্থী ও পথচারীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন।

চট্টগ্রাম : টানা বর্ষণে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে চট্টগ্রাম নগরবাসীকে। গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়েন অফিসগামী যাত্রী ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। টানা বৃষ্টি হওয়ায় নগরের অনেক নিম্ন এলাকায় জমেছে পানি। শুক্রবার বিকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি গতকাল পর্যন্ত কখনো থেমে, কখনো মুষলধারে পড়ছে।        

খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়িতে চেঙ্গি ও দীঘিনালায় মাইনি নদীর পানি বাড়ায় নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। খাগড়াছড়ি সদর ও দীঘিনালা মিলে ২০টি গ্রাম পানির নিচে। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলে খরস্রোতা মাইনি ও চেঙ্গি নদী পানির বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় লোকজন স্থানীয় স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছে। হঠাৎ করে পানি ওঠায় লোকজন দিশাহারা হয়ে পড়েন।

সর্বশেষ খবর