বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

শিক্ষকরা অনড়, বলছেন বাঁচামরার লড়াই

নিজস্ব প্রতিবেদক

সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো অচল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত সর্বজনীন ‘প্রত্যয়’ স্কিম সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনস্কেল প্রবর্তনের দাবিতে শিক্ষকদের কর্মবিরতি চলছে।

গতকালও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এখন সুনসান নীরবতা। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করা শিক্ষকরা জানিয়েছেন, বৈষম্যমূলক পেনশন স্কিম প্রত্যাহারসহ শিক্ষকদের দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত এমন অচলাবস্থা থাকবে। আর দাবি পূরণ হলে স্পেশাল ক্লাস ও স্পেশাল পরীক্ষা নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের এই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া হবে। গত ৩০ জুন সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালনের পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে গত ১ জুলাই থেকে সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা ক্লাস-বর্জন কর্মসূচি চলছে। এদিকে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয় পেনশন স্কিমের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করলেও এই ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছেন শিক্ষক নেতারা। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা গণমাধ্যমকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় কিছু বিষয় স্পষ্ট করে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে আমরা তা দেখেছি। আমরা এ ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছি। এটি মানি না। আমাদের আন্দোলন ও কর্মসূচি চলবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূইয়া গতকাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী যখন সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আইন প্রণয়ন করেছেন, আমরা তখন স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু আমরা বৈষম্যের ‘প্রত্যয়’ স্কিমের বিরোধিতা করছি। তিনি বলেন, আন্দোলন স্থিমিত করার জন্য এখন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ও বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা বলছে পেনশন কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতারা বলছেন, আন্দোলন আমাদের বাঁচামরার লড়াই। বাধ্য হয়েই আমরা আন্দোলনে নেমেছি। আমাদের জেলা প্রতিনিধি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদকরা জানান,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : পেনশন স্কিমের প্রত্যাহারের দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আয়োজনে দ্বিতীয় দিনের মতো সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষকরা। দুপুরে কলাভবনের প্রধান ফটকের ভিতরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূইয়া বলেন, ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে। এটা দুঃখজনক। আমাদের দাবি পূরণ হলে স্পেশাল ক্লাস ও স্পেশাল পরীক্ষা নিয়ে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেবে শিক্ষকরা। এদিকে মঙ্গলবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্যপরিষদের ব্যানারে প্রশাসনিক ভবনের সামনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ও ঢাবি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল মোতালেব বলেন, দাবি মানা হলেই কর্মবিরতি বন্ধ করে কাজে যোগ দেব আমরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মো. আবদুল মোতালেব গতকাল বলেন, রাতের আঁধারে একটি কুচক্রী মহল এবং সচিবরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। সরকার প্রত্যয় স্কিমকে পেনশন স্কিম বললেও এটি আসলে পেনশন স্কিম নয়। এটি অনেকটাই লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মতো। এই লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে পেনশন স্কিম বলে যারা এটি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন তাদের আমরা সাবধান করে দিতে চাই। চলমান আন্দোলনের সময় অফিসের কাজ করতে চাপ দেওয়া হলে অফিস প্রধানদের কক্ষে তালা লাগিয়ে দেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মবিরতিতে গতকাল দ্বিতীয় দিনেও স্থবির ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বাত্মক কর্মবিরতির অংশ হিসেবে দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ও গুচ্ছ ভাস্কর্য চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সব বিভাগসমূহের ক্লাস-পরীক্ষা, অফিস সমূহ বন্ধ ছিল গতকাল। শিক্ষকদের যুক্তিসংগত দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সহযোগী অধ্যাপক শেখ মাশরিক হাসান।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে দ্বিতীয় দিনের কর্মবিরতিতে অচল হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, এ স্কিমের কারণে ভবিষ্যতে যেসব মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতায় আসতে নিরুৎসাহিত হবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাবী শিক্ষক পাবে না। এ দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের আন্দোলন। আমাদের বিশ্বাস এ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করবেন এবং আমাদের দাবি মেনে নিবেন।

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় : প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে কর্মবিরতি থেমে নেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে বলে জানান আন্দোলনকারী শিক্ষকরা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ প্রত্যাহারের দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা ও দাফতরিক কার্যক্রম বর্জন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষক ও কর্মকর্তারা। এতে ক্যাম্পাসে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সংকটে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। বাড়ছে সেশনজটের শঙ্কা।

রাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, বৈষম্যমূলক এই প্রত্যয় স্কিমের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় মেধাবী শিক্ষক হারাবে। ফলে জাতি পিছিয়ে পড়বে। এটি হতে দেওয়া যায় না। তাই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ওপর আরোপ করা প্রত্যয় পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি অব্যাহত রয়েছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন তারা। আর এর ফলে সেশনজটের শঙ্কায় রয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

মাভাবিপ্রবি : পেনশন সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (মাভাবিপ্রবি) গতকাল দ্বিতীয় দিনের কর্মবিরতি পালন করেছে শিক্ষক ও কর্মকর্তারা। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আয়োজনে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করা হয়। দাবি আদায় না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি গ্রহণের ঘোষণা দেন বক্তারা।

খুবি-কুয়েট-খুকৃবি : পেনশন সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তিকরণ ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল বাস্তবায়নের দাবিতে গতকাল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মবিরতি পালিত হয়। কর্মবিরতির কারণে সব ডিসিপ্লিনের ক্লাস, অনলাইন, সান্ধ্যকালীন ক্লাস, প্রফেশনাল কোর্সের ক্লাস, মিডটার্ম, ফাইনাল ও ভর্তি পরীক্ষাসহ সকল ধরনের পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। খুবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. এস এম ফিরোজের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রকিবুল হাসান সিদ্দিকীর সঞ্চালনায় অবস্থান কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের শিক্ষকরা বক্তব্য রাখেন।

বেরোবি : বৃষ্টি উপেক্ষা করে দ্বিতীয় দিনেও কর্মবিরতি পালন করছে শিক্ষকরা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থার। ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকায় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। এতে সেশনজটের শঙ্কায় রয়েছে শিক্ষার্থীরা। বৃষ্টি উপেক্ষা করে বেরোবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. বিজন মোহন চাকী ও সাধারণ সম্পাদক সহযোগী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান মন্ডলের নেতৃত্বে শিক্ষকেরা দাবি আদায়ের পক্ষে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ বলেন, বৈষম্যমূলক এই পেনশন স্কিম জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা যে আন্দোলন করছি, সেটা শুধু আমাদের আন্দোলন নয়, এটা আমাদের শিক্ষার্থী ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আন্দোলন।

হাবিপ্রবি : হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বাত্মক এ কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। ফলে সব ক্লাস, পরীক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থগিত হয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে হাবিপ্রবিতে। হাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজার রহমান বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকব।

যবিপ্রবি : সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় তিন দাবি আদায়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যবিপ্রবি) সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলছে। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ক্লাস, পরীক্ষা ও সব ধরনের দাফতরিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর