বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

ব্ল্যাকমেইলিংয়ের বদলে এমপি হত্যা শাহিনের ধোঁকা

সাখাওয়াত কাওসার

ব্ল্যাকমেইলিংয়ের বদলে এমপি হত্যা শাহিনের ধোঁকা

আনোয়ারুল আজিম আনার

ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারকে কলকাতার সঞ্জীভা গার্ডেনসে ব্ল্যাকমেইলিং করে অর্থ আদায়ের কথা বলা হয়েছিল মিশনে অংশ নেওয়া অনেককেই। এটা বলেই তাদের ভারতে নেওয়া হয়। তবে হত্যার পর তারা লাশ গুম করতে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করেন বলে জানিয়েছেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে।

বলেছেন, ট্র্যাপে ফেলে তাদের হত্যাকান্ডে জড়িত করা হয়েছে। খুন করার পর লাশ গুমে তারা বাধ্য ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক আক্তারুজ্জামান শাহিনের পরিকল্পনায় সবকিছু তদারকি করেন শিমুল ভূঁইয়া। আর্থিক বিষয়টির তদারকি করেন শাহিনের ব্যক্তিগত সহকারী সিয়াম হোসেন। টানা ছয় দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল ফয়সালকে আদালতে হাজির করেন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান। এরপর আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ডের আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। আদালত সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এর আগে গত মঙ্গলবার এ মামলার আরেক আসামি মোস্তাফিজুর রহমান ফকির আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে গ্রেফতার সাতজনের ছয়জনই স্বীকারোক্তমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি দেননি শুধু ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। ডিবি সূত্র জানায়, রিমান্ডে থাকাবস্থায় ফয়সাল এবং মোস্তাফিজ দুজনই দাবি করেছেন কিলিং মিশনের সবাই এমপি আনারকে হত্যার বিষয়ে জানতেন না। শিমুলের মাধ্যমে তারা জানতেন এমপি আনারের অশ্লীল ভিডিও করে ব্লাকমেলে ফেললে মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যাবে। ব্লাকমেলে ফেলার সব ব্যবস্থা করে দেবেন শাহিন। সে উদ্দেশ্যে নির্দেশনা অনুযায়ী মোস্তাফিজ ক্লোরেফরম মেশানো রুমাল দিয়ে নাকে ধরেন। কসাই জিহাদ এবং ফয়সাল দুই পাশ দিয়ে শক্তভাবে ধরে চেয়ারে বেঁধে ফেলেন। তবে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন গলায় ছুরি চালিয়ে দেয়। তখন লাশ টুকরো করে গুম করা ছাড়া তাদের সবার আর কোনো উপায় ছিল না। বিশেষ করে হত্যার দুই দিন আগে শাহিন বাংলাদেশে চলে এলেও শিমুল ভূঁইয়ার সেখানে থেকে যাওয়াটাই ট্রাপের ইঙ্গিত দিচ্ছে বেশি। কারণ চরমপন্থি নেতা শিমুল বেশকিছু হত্যাকা  ঘটালেও নিজে কখনো কিলিং মিশনে অংশ নেননি। নিজের অনুসারী পাঠিয়ে সব হত্যাকা  ঘটাতেন। শিমুল ভূঁইয়া তার জবানবন্দিতে এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। জানা গেছে, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে কিলিং মিশনের আদ্যোপান্ত বেড়িয়ে এলেও সঞ্জীভা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটটিতে তাদের বিচ্ছিন্নভাবে মিলিত হওয়া, এমপি আনারের অশ্লীল ভিডিও করে ব্লাকমেলের আগেই হত্যা করা, বিভিন্ন হত্যাকাে  নির্দেশদাতার ভূমিকা পালন করে আসা চরমপন্থি শিমুল ভূঁইয়ার নিজের উপস্থিতি, কয়েকজনের হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে আগে থেকে না জানার বিষয়গুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন গোয়েন্দারা। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মনে হচ্ছে এ ঘটনার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহিন কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া সদস্যদেরও ধোঁকা দিয়ে ট্রাপে ফেলেন।

জানা গেছে, সবশেষ গ্রেফতার আসামি মোস্তাফিজ ও ফয়সালকে বড় অঙ্কের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে একটা কাজ করে দেওয়ার জন্য কলকাতায় যেতে বলেন শিমুল ভূঁইয়া। জরুরি পাসপোর্ট করার জন্য মোস্তাফিজ ও ফয়সালকে টাকাও দেন শিমুল ভূঁইয়া। ১৫ এপ্রিল খুলনা থেকে ঢাকায় এসে শাহিনের ভাটারার বাসায় ওঠেন মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। পরদিন শাহিনের পিএস সিয়াম হোসেন এসে তাদের ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রে নিয়ে যান। ১৫ থেকে ২৪ এপ্রিল মোস্তাফিজ ও ফয়সাল শাহিনের তত্ত্বাবধানে ভাটারার বাসায় ছিল। এ সময় শাহিনের পিএস সিয়াম হোসেন তাদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল। সিয়াম তাদের জানিয়েছিল, তাদের ভিসার জন্য শাহিন ব্যাংক স্টেটমেন্ট, মেডিকেল প্রেসক্রিপশনসহ আনুষঙ্গিক কাজে প্রচুর টাকা খরচ করেছেন। ২৫ এপ্রিল ভারতীয় মেডিকেল ভিসা পেয়ে ঢাকা থেকে খুলনা ফিরে যান। এরপর শিমুল ও শাহিনের পরিকল্পনা মোতাবেক মোস্তাফিজ ও ফয়সাল ২ মে কলকাতায় যান এবং নিউমার্কেট এলাকায় একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১০ মে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীভা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে যান মোস্তাফিজুর। মিশন শেষে ১৯ মে কলকাতা থেকে ঢাকায় ফেরেন মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। ওঠেন শাহিনের ভাটারার বাসায়। পরবর্তীতে আনারের মেয়ে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করলে মূল ঘাতক শিমুল ভূঁইয়া গ্রেফতার হন। এতে পুলিশের তৎপরতা টের পেয়ে আত্মগোপনে চলে যান মোস্তাফিজ ও ফয়সাল।

প্রসঙ্গত, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য দর্শনার গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এমপি আনার। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মন্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। পরদিন চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ আনোয়ারুল আজীম। এরপর ২২ মে খবর ছড়ায় কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় বহুতল সঞ্জীভা গার্ডেনস নামে একটি আবাসিক ভবনে আনার খুন হয়েছেন। এ ঘটনায় ২২ মে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।

সর্বশেষ খবর