শনিবার, ৬ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

নিরঙ্কুশ জয়ে প্রধানমন্ত্রী স্টারমার

প্রভাবশালী মন্ত্রী এমপি ধরাশায়ী

আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য

নিরঙ্কুশ জয়ে প্রধানমন্ত্রী স্টারমার

‘আনন্দলোক দ্বার খুলেছে, আকাশ পুলক-ময়, জয় ভূলোকের, জয় দ্যুলোকের, জয় আলোকের জয়’- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতোই চারদিকে জয়ের বার্তা নিয়ে লেবার পার্টি ব্র্রিটেনের ক্ষমতা গ্রহণ করল। এ জয় ছিল বহু আকাক্সিক্ষত, ছিল বহু প্রতীক্ষিত। বিজয়ের হাসি হেসেছেন লেবার পার্টি নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার। ১৪ বছর পর ক্ষমতায় ফিরল লাল গোলাপের দল। এর ভিতরে তাদের দেখতে হয়েছে চারটি পরাজয়।

যুক্তরাজ্যে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৪১২টি আসনে জয় পেয়েছে লেবার পার্টি। কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ১২১টি আসন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য কোনো দলের প্রয়োজন হয় ৩২৬ আসন। যুক্তরাজ্যে জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমারকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান রাজা দ্বিতীয় চার্লস। কিয়ার স্টারমার গতকাল শুক্রবার বাকিংহাম প্রাসাদে রাজার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। কিয়ার স্টারমার হলেন ব্রিটেনের ৫৮তম প্রধানমন্ত্রী। বাকিংহাম প্রাসাদের প্রকাশ করা একটি ছবিতে দেখা গেছে, রাজা চার্লস স্টারমারের সঙ্গে করমর্দন করছেন। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ঋষি সুনাকের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যে টানা ১৪ বছর পর ক্ষমতা থেকে সরে গেল কনজারভেটিভ পার্টি। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর কিয়ার স্টারমার বলেন, ‘পরিবর্তন এখন থেকেই শুরু হলো।’ আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার প্রথম ভাষণে স্টারমার বলেছেন, জনগণ সুচিন্তিতভাবে পরিবর্তন এবং জনগণের সেবামূলক রাজনীতির জন্য ভোট দিয়েছে। তবে ‘এই পরিবর্তনের জন্য সময় লাগতে পারে’ জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো দেশকে পরিবর্তন করা সুইচ টেপার মতো বিষয় নয়। এর জন্য সময় প্রয়োজন হবে। তবে পরিবর্তনের জন্য কাজ শুরু করা হবে। ইটের ওপর ইট তুলে দেশের অবকাঠামো পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্টারমার। নতুন নতুন বিদ্যালয় ও ঘর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমার মতো খেটে খাওয়া পরিবারগুলো যাতে জীবন চালাতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’

এদিকে চলতি বছরের নির্বাচনে ব্রিটেনের অর্থনীতি, জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা, অভিবাসন ইত্যাদি নিয়ে নানা সমস্যা থাকলে গাজা ইস্যু নিয়ে অভিবাসী এলাকায় বেশ চাপের মুখে ছিল রাজনৈতিক দলগুলো। ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি জিতলেও দলটির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু এলাকায় তাদের প্রার্থীরা গাজাপন্থি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হেরে গেছেন। আরও অনেকে পড়েছেন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এর মধ্যে দলটির জন্য বড় আঘাত হলো শ্যাডো মিনিস্টার জনাথন অ্যাশওয়ার্থ লেস্টারের সাউথ আসনে হেরে যাওয়া। যেখানে আগে প্রায় ২২ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছিলেন তিনি। ১০ শতাংশের বেশি মুসলিম ভোট আছে এমন আসনগুলোতে লেবার পার্টির ভোট কমেছে গড়ে ১১ শতাংশ।

পূর্ব লন্ডনের বেথনালগ্রিন অ্যান্ড স্টেফনি আসনে ছায়ামন্ত্রী রুশনারা আলী আগে ৩১ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছিলেন। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী আজমল মাশরুরকে তিনি হারিয়েছেন ১৬৯৮ ভোটের ব্যবধানে। এমনকি নির্বাচনি প্রচারণার সময় লেবার নেতা স্টারমার নিজেও ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ প্ল্যাকার্ডের মুখোমুখি হয়েছেন এবং তার ভোটের ব্যবধান কমেছে। গাজাপন্থি স্বতন্ত্র প্রার্থী এন্ড্রু ফেইনস্টেইন পেয়েছেন ৭৩১২ ভোট। একই অবস্থা পপলার ও লাইমহাউস প্রার্থী আপসানার ক্ষেত্রেও। যদিও তিনি ভালো ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন। তারপরও তার ভোট গতবারের চেয়ে প্রায় অর্ধেক কমেছে।

ইলফোর্ড নর্থে শ্যাডো স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওয়েস স্ট্রিটিং আগে জয়লাভ করেছিলেন ৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে। এবার তার জয়ের পার্থক্য মাত্র ৫২৮ ভোট। তবে জর্জ গ্যালাওয়ের কাছ থেকে রোচডেলের আসন পুনরুদ্ধার করেছেন লেবার প্রার্থী পল ওয়াহ। যেখানে মুসলিম ভোটার বেশি সেখানেই দলটি খারাপ করেছে। যতটুকু জানা গেছে লেবার অধিক মুসলিম জনগোষ্ঠী আছে এমন পাঁচটি আসনে হেরে গেছে। এর মধ্যে চারটিতে স্বতন্ত্র আর একটিতে কনজারভেটিভ প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। লেস্টার সাউথ আসনে শোকাত অ্যাডাম ৯৭৯ ভোটে জয়ের পর ঘোষণা করেছেন ‘এটা গাজার জন্য’। এ আসনে ৩০ শতাংশ ভোটার মুসলিম। ১৩ বছর ধরে অ্যাশওয়ার্থ আসনটি ধরে রেখেছিলেন। কাছেই লেস্টার ইস্ট আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কয়েক হাজার ভোট পাওয়ায় সুবিধা পেয়েছেন কনজারভেটিভ প্রার্থী। বিশেষ করে সাবেক লেবার এমপি ক্লাউডিয়া ওয়েব্বের এলাকায়।

ওয়েব্বে হয়রানির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। তবে তিনি ফিলিস্তিনপন্থি হিসেবে সোচ্চার কণ্ঠ। তার সাবেক আসনে টোরি প্রার্থী জয় পেয়েছে ৪৪২৬ ভোটে, যা মিস ওয়েব্বের প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে কম। বার্মিংহামের পেরি বার এলাকা লেবারের খালিদ মাহমুদ ৫৭০ ভোটে হেরে গেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আইয়ুব খানের কাছে। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যারা গাজাকেই তাদের প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছিলেন তারা ডিউজবুরি, বাটলে, ব্ল্যাকবার্ন এলাকায় জয়ী হয়েছেন, যেখানে আগে লেবার পার্টির ভালো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল।

মুসলিম জনগোষ্ঠী বেশ বড় এমন আরও কিছু এলাকায় সিনিয়র লেবার নেতারা খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে জয়ী হতে পেরেছেন। ইলফোর্ড নর্থে স্বতন্ত্র প্রার্থী লিয়ানে মোহামাদ, যিনি একজন ফিলিস্তিনি শরণার্থীর নাতি, স্ট্রিটিংয়ের চেয়ে ৫২৮ ভোট পেছনে ছিলেন। বার্মিংহাম লেডিউডে ছায়া বিচারমন্ত্রী শাবানা মাহমুদকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আইনজীবী আহমেদ ইয়াকুব। টিকটকে ইয়াকুবের অনুসারীর সংখ্যা অনেক। তবে শাবানা মাহমুদের জয়ের পার্থক্য ৩২ হাজার থেকে কমে হয়েছে ৩৪২১ ভোট। একইভাবে জেস ফিলিপস পার্লামেন্টে গাজার যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য লেবার পার্টির সামনের সারি ছাড়তে হয়েছিল। ভোটে নির্বাচিত হলেও এবার তিনি জয়লাভ করেছেন ৬৯৩ ভোটের ব্যবধানে। ফিলিপস জয়ের পর যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন অনেকে চিৎকার করেছে। তিনি বলেছেন ‘আমি যত নির্বাচন করেছি তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে খারাপ’। তিনি দাবি করেন তার প্রচার কর্মীরা বাধা ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

ইসলিংটন নর্থ আসনে সাবেক লেবার নেতা জেরেমি করবিন জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। তিনি লেবার প্রার্থীর চেয়ে ৭ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন। এন্টিসেমিটিজম বিষয়ক এক রিপোর্টে প্রতিক্রিয়ার কারণে দলে তার সদস্যপদ স্থগিত হয়েছিল। রোচডেইলে লেবার পার্টির পল ওয়াহর কাছে হেরেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা গ্যালাওয়ে। কয়েক মাস আগেই এক উপনির্বাচনে তিনি জিতেছিলেন।

গাজা দ্বন্দ্বের বিষয়ে অবস্থানের জন্য লেবার পার্টির ওপর চাপ ক্রমশ বাড়ছে। ইসরায়েলে গত ৭ অক্টোবরে হামাসের হামলার জবাবে ইসরায়েল গাজায় অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিল লেবার পার্টি। কিন্তু সমালোচকদের মতে, পার্টির এ অবস্থানে পৌঁছার গতি ছিল খুবই ধীর। নির্বাচনি ইশতেহারে লেবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। গত বছর স্টারমারের বক্তব্য নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন- ইসরায়েলের গাজায় পানি ও জ্বালানি বিচ্ছিন্ন করার ‘অধিকার’ আছে। পরে তিনি এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন দেশটির আত্মরক্ষার অধিকার আছে।

হেরেছেন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপি : যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক মন্ত্রী ও প্রভাবশালী এমপি পরাজিত হয়েছেন। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির ভরাডুবি হয়েছে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বিরোধী লেবার পার্টি। গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের মন্ত্রিসভার অন্তত ৯ জন সদস্য হেরেছেন। আগের রেকর্ডটি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির সরকারের সাতজন মন্ত্রী পরাজিত হয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে পরাজিত মন্ত্রীদের মধ্যে আছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্র্যান্ট শ্যাপস, কমন্স নেতা পেনি মর্ডান্ট, বিচারমন্ত্রী অ্যালেক্স চক, শিক্ষামন্ত্রী গিলিয়ান কিগান, সংস্কৃতিমন্ত্রী লুসি ফ্রেজার, বিজ্ঞানমন্ত্রী মিশেল ডোনেলান, প্রবীণবিষয়ক মন্ত্রী জনি মার্সার, ওয়েলসবিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড টিসি ডেভিস, পরিবহনমন্ত্রী মার্ক হারপার।

এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস তার নিজ আসনে ৬৩০ ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন। সাবেক কোনো প্রধানমন্ত্রীর এমন শোচনীয় পরিণতি আর হয়নি। এই লিজ ট্রাসের হাত ধরেই পতনের ঘণ্টা বাজে কনজারভেটিভ সরকারের। মাত্র ৪৫ দিনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ৪১ দিনের মাথায় স্বপ্নবিলাসী একটি বাজেট দিয়ে দেশের অর্থনীতির ধস নামান তিনি। রাতারাতি মুদ্রাস্ফীতি ১১-তে চলে যায়, যা ইতিহাসে প্রথম ডাবল ডিজিট মুদ্রাস্ফীতি ছিল। তারও চার দিনের মাথায় তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে প্রথমবারের মতো ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাকের হাতে যায় দল ও দেশের দায়িত্ব। তবে সেই খাদ থেকে আর তুলতে পারেননি তিনি। নির্বাচনে ৪১২ আসনে জয় পেয়েছে লেবার পার্টি। কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ১২১ আসন। লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টি পেয়েছে ৭১ আসন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ৩২৬ আসনে জয় প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর