সোমবার, ৮ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

চীনা বিনিয়োগে বাণিজ্য বাড়ানোর কৌশল

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বাংলাদেশের আমদানি বাণিজ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। সারা বিশ্ব থেকে বাংলাদেশ যা আমদানি করে তার ২৮ ভাগের বেশি আসে চীন থেকে। বিপরীতে সারা বিশ্বে যা রপ্তানি করে বাংলাদেশ, তার মাত্র ১ শতাংশের কিছু বেশি যায় চীনে। আকাশসম এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এবার চীনা বিনিয়োগ টানার কৌশল নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের প্রায় ২০টি সম্ভাবনাময় খাতে চীনের উদ্যোক্তাদের একক ও যৌথ বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হবে। পাশাপাশি দেশটির বিনিয়োগকারীদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হবে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বর্তমানে চীনে ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। এরপরও বাংলাদেশের রপ্তানি সে হারে বাড়েনি। সরকার মনে করছে, দুই দেশের বিশালাকারের বাণিজ্য ঘাটতি শুধু রপ্তানি কৌশল দিয়ে কমানো সম্ভব নয়। এ কারণে দেশটির সঙ্গে সামগ্রিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব অর্থাৎ কম্প্রিহেনসিভ ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক পার্টনারশিপ চুক্তি (সেপা) নিয়ে আলোচনা চলছে। সেপার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে চীনা উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের সামনে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় খাতগুলো তুলে ধরে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হবে। চীনের বিনিয়োগ বাড়লে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় খাতগুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফর সংক্রান্ত বিষয়ে তারাই ব্রিফ করবেন।  

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে কৃষি, আইসিটি, হাইটেক পার্ক, টেক্সটাইল, অটোমোবাইল, চামড়া এবং সোলারসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এ ছাড়া ব্যাংক-বিমার মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও তারা কৌশলগত বিনিয়োগে আসতে চায়। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। তবে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় কোনো চুক্তি না থাকায় চীনা বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছে না। এ বিনিয়োগ সুরক্ষা দিতেই এবার প্রধানমন্ত্রীর সফরে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহায়তা নিয়ে একাধিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হওয়ার কথা রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাত বাদে অন্যান্য খাতে চীনা বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ চাইছে পোশাক খাতের বাইরে সম্ভাবনাময় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক, ইলেকট্রনিক্স গুডস, হাইটেক পার্ক-বিশেষ করে সেমি-কন্ডাক্টর উৎপাদনে চীনা বিনিয়োগ টানতে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে চাইনিজ ইকোনমিক জোন রয়েছে। চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রস্তুত করার আশ্বাস দেওয়া হবে। এ ছাড়া বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে সেমি-কন্ডাক্টরের বিপুল চাহিদা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে চীনা বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি যদি বাংলাদেশের হাইটেক পার্কে এনে সেমি-কন্ডাক্টর উৎপাদনে যেতে পারে-তবে দেশের রপ্তানি আয় এই এক খাত থেকেই কয়েক বিলিয়ন ডলার বাড়ানো সম্ভব।  আগামী ২০২৯ সালে অতি সম্ভাবনাময় বৈশ্বিক সেমি-কন্ডাক্টর শিল্পের মার্কেট ভ্যালুর আকার প্রায় ১ দশমিক ৩৮ ট্রিলিয়ন ডলারে উঠে যেতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন এ খাতের বিশ্লেষকরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ এবং চীন উভয়ই এশিয়া প্যাসিফিক প্রেড এগ্রিমেন্ট (আপটা)-এর সদস্য। আপটার সদস্য হিসেবে স্থানীয়ভাবে মূল্য সংযোজনের শর্তে চীনে ৮৩টি পণ্যে এবং ডব্লিউটিওর আওতায় আরও প্রায় ৫ হাজার পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছিল বাংলাদেশ। পরে ২০২০ সালের ১৬ জুন শর্তহীনভাবে বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ রপ্তানি পণ্য (৮ হাজার ২৫৬টি পণ্য) দেশটির বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয় চীন, যা ওই বছরের ১ জুলাই কার্যকর হয়। এরপর ২০২২ সালের শুরুতে বাংলাদেশের জন্য আরও ১ শতাংশ পণ্যকে (৩৮৩টি) শুল্কমুক্ত সুবিধার ঘোষণা দেয় দেশটি, যা ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়। কিন্তু এসব সুবিধার পরও দেশটিতে রপ্তানি বাড়েনি। বরং আগের তুলনায় পণ্য রপ্তানির পরিমাণ কমে গেছে। ২০২৬ সালে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের পর চীনে ৯৮ শতাংশ শুল্ক সুবিধা আর পাওয়া যাবে না। সেই সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি সেপা নিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে দুই দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার বিষয়গুলো সেই চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই প্রস্তুত করা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সদ্য সাবেক সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, প্রচলিত রপ্তানি কৌশল দিয়ে চীনে বাণিজ্য বাড়ানো সম্ভব নয়। কারণ ২০২৬ সালের পর চীনে আর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে না। সে কারণে মুক্ত বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে এ ধরনের চুক্তি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রীর সফরে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহায়তা বিষয়ে একাধিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এসব চুক্তির মাধ্যমে চীনা বিনিয়োগ আনতে পারলে সেখান থেকেই দেশটিতে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব।

 

সর্বশেষ খবর