শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

শেয়ারবাজারে সর্বনাশ কারসাজি সিন্ডিকেটে

নামসর্বস্ব কোম্পানির শেয়ারে জালিয়াতি, শত কোটির কারসাজি মুনাফায় নামমাত্র জরিমানা

আলী রিয়াজ

কারসাজি সিন্ডিকেটে সর্বনাশ হচ্ছে শেয়ারবাজারের। সিরিয়াল ট্রেড করে শত শত কোটি টাকার মুনাফা করছে এই সিন্ডিকেট। জালিয়াতি ধরা পড়লেও সামান্য জরিমানা দিলেই সব বৈধ হয়ে যায়। এই সিন্ডিকেটে জড়িত নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে স্টক এক্সচেঞ্জের কিছু অসাধু কর্তাব্যক্তি। মূলত শেয়ার বাজার কারসাজি সিন্ডিকেট দুর্বল কোম্পানির শেয়ার নিয়েই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পথে বসিয়েছে। শেয়ারবাজার অস্থিরতায় এখন দুর্বল কোম্পানিগুলোর কারণে চরম হতাশাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্বল নামসর্বস্ব কোম্পানি তালিকাভুক্ত করে শেয়ারবাজার খালি করে দিয়েছে। এগুলো পুরো শেয়ারবাজারকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। গত কয়েক বছরে নামসর্বস্ব কোম্পানি বাজারে এসেছে। যারা বাজার শূন্য করে দিচ্ছে। এখন সময় হয়েছে এসব নামসর্বস্ব দুর্বল কোম্পানি বাজার থেকে বের করে দেওয়ার।

শেয়ারবাজারে এসএমই বোর্ডে তালিকাভুক্ত হিমাদ্রি লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে তিন প্রতিষ্ঠান ও একজন ব্যক্তি মাত্র ৫ মাসে ৮২ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন। তারা কারসাজির মাধ্যমে ৮২ কোটি টাকা মুনাফা করলেও এর বিপরীতে তাদের জরিমানা করা হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাম্প্রতিক এক তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ২৭ এপ্রিল হিমাদ্রির প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৩৮ টাকা ৮০ পয়সা। টানা মূল্যবৃদ্ধির ফলে ১৭ সেপ্টেম্বর একটি শেয়ারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৭৪ টাকায়। সে হিসাবে প্রায় ৫ মাসে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য ৬ হাজার ৪৩৫ টাকা বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে বাজারে লেনদেন হওয়া কোম্পানিটির বেশির ভাগ শেয়ারের এবং সিরিজ লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিল ইনোভা সিকিউরিটিজের এমডি রফিকুল বারী ও তার মালিকানাধীন এআর ট্রেডার্স এবং অভি ব্রিকস ও মুনীর ট্রেডার্স। তারা নিজেদের মধ্যে শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করে শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়েছে। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড ২০১৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। তালিকাভুক্তির পরপরই এই কোম্পানির শেয়ারে কারসাজির বিষয়টি সামনে চলে আসে। কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে ওঠানামা করেছে। ডিএসইর তদন্তে দেখা গেছে, ২০২১ সালের ১৬ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত মাত্র ১৫ দিনে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৬৯ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ার ৬৩ টাকা থেকে ৯২ টাকায় লেনদেন হয়েছে। এই চক্রটি ৩৫ লাখ ৬০ হাজার ১৮৫টি শেয়ার কিনেছে। আলোচ্য ১৫ দিনে বিক্রি করেছে ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ৫০টি শেয়ার। এতে গ্রুপটির মুনাফা (রিয়ালাইজড) হয় ৯২ লাখ ৩০ হাজার ৫১৫ টাকা। পরে কারসাজি প্রমাণিত হওয়ায় তাদের মাত্র ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি।

এভাবে বছরের পর বছর নানা ধরনের কারসাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাট চলছে শেয়ারবাজারে। বাজারে নাম সর্বস্ব কিছু কোম্পানি শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে এখন বিনিয়োগকারীরে কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না। পরিচালকরা টাকা নিয়ে শেয়ার কারসাজিতে জড়িত হচ্ছেন। বন্ধ রয়েছে নিজেদের কোম্পানির উৎপাদন। বছরের পর বছর এভাবে পড়ে রয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ বন্ধ কোম্পানি চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। ডিএসইর চিহ্নিত কোম্পানির মধ্যে রয়েছে, কে অ্যান্ড কিউ, মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ, দুলামিয়া কটন, বেক্সিমকো সিনথেটিক, সমতা লেদার, সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি শ্যামপুর সুগার, জিল বাংলা সুগার এবং বস্ত্র খাতের আরেক কোম্পানি ইমাম বাটন, মেঘনা কনডেন্টস মিল্ক, বিডি ওয়েল্ডিং, জুট স্পিনার্স, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ, বিডি অটোকারস, এমারেল্ড ওয়েল, বাংলাদেশ সার্ভিস, বিচ হ্যাচারি, ঢাকা ডাইং অ্যান্ড ম্যানুফেকচারিং, হক্কানি পাল্প, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, মিথুন নিটিং, সোনারগাঁও টেক্সটাইল, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক, তাল্লু স্পিনিং, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, মুন্নু সিরামক, মুন্নু স্টাফলার, সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল এবং তুং হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইং।

এ ছাড়া কারসাজি, জালিয়াতি, বার্ষিক সাধারণ সভা-এজিএম না করাসহ নানা অভিযোগে বিএসইসি ২২ কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে পাঠিয়েছে। এই ২২ কোম্পানি হলো অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, আরামিট সিমেন্ট, আজিজ পাইপস, ডেল্টা স্পিনার্স, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, জিবিবি পাওয়ার, ইনটেক লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, কেয়া কসমেটিকস, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, ন্যাশনাল টি কোম্পানি, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, রিজেন্ট টেক্সটাইল মিলস, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি (বিডি), রিংশাইন টেক্সটাইলস, সাফকো স্পিনিং মিলস, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ঢাকা ডায়িং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইয়াকিন পলিমার ও জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

বিএসইসি উদ্যোগ নিয়েছে কিছু কোম্পানি বাজার থেকে তালিকাচ্যুত করার। যেসব প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিন থেকে উৎপাদন বন্ধ, সেগুলো তালিকাচ্যুত করা হবে। আর যেগুলো চালুর সম্ভাবনা রয়েছে, সেসব ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) মার্কেটে পাঠানো হবে। এমারেল্ড অয়েল নামে একটি কোম্পানি ২০১৪ সালে তালিকাভুক্তির এক বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়েছে। শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে এক টাকাও বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়নি। শেয়ারবাজারে ২০১৪ সালে ১৭টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়। এই ১৭ কোম্পানি মধ্যে ১৬ কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ। কখনো চালু হবে এমন সম্ভাবনাও নেই। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ কোনো বাছবিচার না করে এমন কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করেছে। ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধসের পরও সতর্ক হয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ওই সময় গঠিত কমিশন একের পর এক দুর্বল কোম্পানিকে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দিয়েছে। গত ১৪ বছরে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি বৃহৎ মূলধনী। যেগুলো বাজার স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রেখেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান বলেছেন, একটি কোম্পানির ১৫ টাকা দামের শেয়ার ৬ হাজার টাকা হয়। এটা কীভাবে সম্ভব? অবশ্যই কেউ না কেউ কারসাজি করেছে। এখন এই কারসাজিতে জড়িতদের সাজা দিতে হবে। কিন্তু ২০২২ সালের অনিয়ম ২০২৪ সালে এসে সামান্য জরিমানা করলেন। তাতে কি হলো। সময় উপযোগী শাস্তি দিতে হবে। এসব অনিয়মকারীদের ধরার দায়িত্ব বিএসইসি, ডিএসইর। তারা সঠিক সময় ধরছে না। ২০১৮/১৯ সালে আমরা ডিএসই থেকে কয়েকটি কোম্পানি আইপিও তালিকাভুক্ত করতে আপত্তি দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সে সুপারিশ রাখা হয়নি। এটা বাজারের জন্য খুব খারাপ বার্তা দিয়েছে। বাজার থেকে টাকা নিয়ে যারা বিদেশে পাচার করছে তাদের সুরক্ষা দিচ্ছে নিয়ন্ত্রকরা। শত কোটি টাকার শেয়ার জালিয়াতি করার উদ্দেশ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানি। নাম সর্বস্ব কোম্পানি নতুন করে যাচাই করতে পারে বিএসইসি। যদি অনিয়ম হয় বা বন্ধ থাকে তাদের বাজার থেকে ডিলিস্ট করা যেতে পারে। তাতে নাম সর্বস্ব কোম্পানি আর আসতে সাহস পাবে না।

জানতে চাইলে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ফুলিয়ে-ফাপিয়ে যেসব কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হয় তাদের বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়া দরকার। যারা জাঙ্ক শেয়ার নিয়ে জালিয়াতি করছে। তাদের নামমাত্র জরিমানা করে আরও উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। যেসব কোম্পানির কোনো উৎপাদনে নেই, শুধু অনিয়ম কারসাজি করছে তাদের বাজারে রাখা উচিত নয়।

সর্বশেষ খবর