বুধবার, ১০ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

দিল্লিতে বাংলাদেশি কিডনি পাচার চক্র

ভারতে অ্যাপোলো হাসপাতালের নারী চিকিৎসকসহ গ্রেফতার ৭

নয়াদিল্লি ও কলকাতা প্রতিনিধি

দিল্লিতে বাংলাদেশি কিডনি পাচার চক্র

দরিদ্র বাংলাদেশি রোগীদের অর্থের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লি। এরপর সেখানকার হাসপাতালে ভর্তি করে সরিয়ে ফেলা হয় কিডনি। গত দুই বছরে ১৫-১৬ জনের কিডনি অপসারণ করেছে আন্তর্জাতিক সংঘবদ্ধ চক্র। গতকাল নয়াদিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. বিজয়া কুমারীকে (৫০) গ্রেফতার করলে বেরিয়ে আসে কিডনি পাচারের ভয়াবহ তথ্য। অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিডনি সহ শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন চক্র ফাঁস করেছে দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ। আন্তর্জাতিক এই পাচার চক্রের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই চিকিৎসকসহ দিল্লি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে মোট সাত অভিযুক্ত।

দিল্লি পুলিশের ডিসিপি (ক্রাইম ব্রাঞ্চ) অমিত গোয়েল জানান, আন্তর্জাতিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের অভিযোগে এখনো পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই পাচার চক্রের মাস্টারমাইন্ড একজন বাংলাদেশি নাগরিক। কিডনি দাতা এবং প্রাপক বাংলাদেশি। রাসেল নামে আমরা এক বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করেছি। তিনি দাতা এবং প্রাপকদের জোগার করতেন।  জানা গেছে, ডা. বিজয়া কুমারীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠার পরই দায়িত্ব থেকে তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার চক্রের ঘটনায় ওই চিকিৎসক ছাড়াও দিল্লি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে তার সহকারী হিসাবে কর্মরত বিক্রম, বাংলাদেশি নাগরিক রাসেল, মোহাম্মদ সুমন মিয়া, মো. রোকন, ইফতি এবং ভারতের ত্রিপুরার বাসিন্দা রতিশ পাল। জানিয়েছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারকারী এই চক্রের সঙ্গে কাজ করা একমাত্র চিকিৎসক ছিলেন বিজয়া কুমারী। ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত নয়ডা-ভিত্তিক বেসরকারি ‘যথার্থ’ নামক হাসপাতালে প্রায় ১৫-১৬ জনের কিডনি প্রতিস্থাপন করেছিলেন তিনি। পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, যে মূলত গরিব বাংলাদেশি নাগরিকদের টার্গেট করা হতো এই কাজে। অভিযুক্ত চিকিৎসক বিজয়া কুমারী ও তার সহযোগীরা এবং এজেন্টদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। সেই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই বাংলাদেশি রোগীদের টার্গেট করে, অর্থের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসা হতো ভারতে। তদন্তে নেমে দিল্লি পুলিশের হাতে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের নাম করে ভুয়া নথি তৈরি করা হতো যেখানে কিডনি দাতা এবং প্রাপকের (উভয় বাংলাদেশি) মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করা হতো। তাদের উভয়ের সম্মতিতেই এই কিডনি দেওয়া হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হতো তাতে। কারণ, ভারতীয় আইন অনুসারে এই সম্মতি প্রদান বাধ্যতামূলক। যেহেতু দেশটিতে অর্থের বিনিময়ে কিডনিসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেই সমস্ত ভুয়া নথিও জব্দ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। একজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট এবং কিডনি প্রতিস্থাপনকারী সার্জন বিজয়া কুমারী প্রায় ১৫ বছর আগে অ্যাপোলো হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ‘যথার্থ’ হাসপাতালের অতিরিক্ত মেডিকেল সুপারিনটেনডেন্ট সুনীল বালিয়ান বলেন, ‘বিজয়া কুমারী তাদের হাসপাতালে একজন ‘ভিজিটিং কনসালটেন্ট’ হিসাবে কাজ করছিলেন এবং তিনি যে সমস্ত রোগীদের নিয়ে আসতেন তাদেরই কিডনি প্রতিস্থাপন করেছিলেন। যথার্থ হাসপাতালের তরফে কোনো রোগী তার কাছে পাঠানো হয়নি এবং গত তিন মাসে তিনি মাত্র একটি অস্ত্রোপচার করেছেন।’ পুলিশের কাছ থেকে এ বিষয় জানার পরে বিজয়া কুমারীকে সাসপেন্ড করেছে ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতাল (আইএএইচ)। জানা গেছে, অর্থের প্রলোভন দিয়ে সম্ভাব্য বাংলাদেশি কিডনি দাতাদেরকে দিল্লিতে নিয়ে আসত। কিডনি দাতা পিছু প্রত্যেককে ৪ থেকে ৫ লাখ রুপি দেওয়া হতো, পরিবর্তে কিডনি বাবদ প্রাপকদের কাছ থেকে দাবি করা হতো ২৫-৩০ লাখ রুপি।

পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছে ‘সম্প্রতি ভারতের রাজস্থানে একটি কিডনি পাচার চক্র ফাঁস হওয়ার পর আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি এবং তার ভিত্তিতে পুলিশ প্রায় তিন মাস আগে তদন্তও শুরু করেছে। এরপর থেকে একে একে এই চক্রের সাত জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে ২ থেকে ৩ লাখ রুপি দেওয়া হতো বলেও জানিয়েছেন অভিযুক্তরা।

জানা গেছে, আল শিফা নামে একটি মেডিকেল ট্যুরিজম কোম্পানির মাধ্যমে কিডনি দাতা ও গ্রহীতাদের দিল্লিতে থাকা, চিকিৎসা এবং যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়গুলো করা হতো। ইতোমধ্যেই ফৌজিদারি মামলার অধীন ১৬৪ ধারায় কিডনি দাতাদের গোপন জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। এমন একটি সংগঠিত অপরাধ চক্রের তদন্তে নেমে পুলিশের কর্মকর্তারা জেনেছেন, কুষ্টিয়ার বাসিন্দা রাসেল দিল্লির যশোলা এলাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন। সেই ভাড়া করা ফ্ল্যাটে পাঁচ থেকে ছয়জন কিডনি দাতা নিয়ে রাখেন। ওই কিডনি যাদেরকে দেওয়া হবে সেই কিডনি গ্রহীতারাও ওই ফ্ল্যাটে এসে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। অভিযান চালানোর সময় ওই ফ্ল্যাট থেকেই গ্রেফতার করা হয় রাসেল সহ কয়েকজন অভিযুক্তকে। গ্রেফতারের সময়, রাসেলের ঘর থেকে উদ্ধার হয় একটি ব্যাগ। এর মধ্যে ছিল নয়টি পাসপোর্ট, দুটি ডায়েরি এবং একটি রেজিস্টার। ওই পাসপোর্টগুলো ছিল কিডনি দাতা এবং প্রাপকদের এবং ডায়েরিতে দাতা এবং প্রাপকের মধ্যে কিডনি কেনাবেচা সম্পর্কিত যে আর্থিক লেনদেন হয়েছে তার বিবরণ ছিল বলে জানা গেছে। মোহাম্মদ রোকনের কাছ থেকে আরও একটি ব্যাগ জব্দ করেছে পুলিশ। যার মধ্যে থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২০টি স্ট্যাম্প এবং দুটি স্ট্যাম্প ইঙ্ক প্যাড (নীল এবং লাল)। পুলিশের ধারণা এগুলো ভুয়া নথি তৈরি করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর