বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

প্রশ্নফাঁসে ফাঁসছেন আরও কর্মকর্তারা

তালিকা হচ্ছে চাকরিপ্রাপ্তদের

সাখাওয়াত কাওসার

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িত অনেক শীর্ষ কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে আসছে। তারা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে প্রশ্নপত্র এ চক্রের হাতে তুলে দিতেন। আবার মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব প্রশ্ন পেয়ে অনেকে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে বর্তমানে চাকরিরত রয়েছেন। গ্রেফতারদের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই এসব তথ্য উঠে এসেছে। অন্যদিকে, গ্রেফতার ব্যক্তি এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের ব্যাংক হিসাব স্থগিতের বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইনস্টিটিউটে (বিএফআইইউ) প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। একই সঙ্গে মানি লন্ডারিং আইনে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট ও আদালত সূত্র বলছেন, গ্রেফতার অনেকের মোবাইল ফোনে ‘গুরু’ নামে সেভ করা ছিল সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর মোবাইল নম্বর। আবেদ আলীকে তারা গুরু নামেই সম্বোধন করতেন। আবেদ আলীই প্রশ্নপত্রপ্রত্যাশী এবং পিএসসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে পুরো বিষয়টির সমন্বয় করতেন। প্রশ্নফাঁস এবং চাকরি পাওয়ার সময় স্থায়ী ঠিকানার তথ্য ভুল দেওয়ার অভিযোগে চাকরি চলে গেলেও পিএসসির দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেটের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল আবেদ আলীর। স্পর্শকাতর এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পরও আবেদ আলীকে অর্থ উপার্জনের জন্য নির্ভরযোগ্য মেশিন হিসেবে ব্যবহার করতেন তাদের অনেকেই। এ বিষয়ে গতকাল জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এজাহারে যাদের নাম এসেছে তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি।’ জানা গেছে, পিএসসির সাবেক সদস্য মাহফুজুর রহমানের নামটি এরই মধ্যে আবেদ আলীসহ আরও কয়েকজনের জবানিতে উঠে এসেছে। একসময় তার গাড়িও চালাতেন আবেদ আলী। মাহফুজুর রহমান বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী। গ্রেফতারদের যাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাদের বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তবে এরই মধ্যে গ্রেফতারদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত মোবাইল ফোনসহ ইলেকট্রনিক ডিভাইসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে সিআইডি। প্রশ্নফাঁসের সুযোগ নিয়ে প্রজাতন্ত্রে বিভিন্ন ক্যাডারসহ নন-ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন এমন ব্যক্তিদের তালিকা করে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছেন তারা। যাচাইবাছাইয়ের পর নিশ্চিত হওয়া সাপেক্ষেই তাদের আইনের আওতায় নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা।

জানা গেছে, পিএসসির একজন সদস্যের কক্ষ থেকেই প্রশ্নপত্র বিভিন্ন সময় ফাঁস হয়েছে বলে গ্রেফতার পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম ও খলিলুর রহমান স্বীকারোক্তিমূলক জবানিতে উল্লেখ করেছেন। আবার বিজি প্রেসে কর্মরত রয়েছেন এমন অন্তত চারজনের নাম উঠে এসেছে গ্রেফতারদের জবানিতে। তারা বলেছেন, পিএসসির উপপরিচালক (ডিডি) মো. আবু জাফর ও সহকারী পরিচালক (এডি) মো. আলমগীর কবির দুজনই তাদের কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিপুল পরিমাণ অর্থ কামিয়েছেন। তাদের কোচিং সেন্টারের বিষয়টি পিএসসিতে ওপেন সিক্রেট থাকার পরও বহাল তবিয়তে ছিলেন তারা। গত সোমবার বিকালে গ্রেফতারের পর মঙ্গলবার আদালতে পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ছয়জন নিজেদের সম্পৃক্ততা কবুল করে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি দেওয়া অন্য পাঁচজন হলেন অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান, সাজেদুল ইসলাম, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং বেকার যুবক লিটন সরকার। বাকিদের প্রত্যেকের বিষয়ে আজ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করবেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্তসংশ্লিষ্ট এক সূত্র বলছেন, আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়া ছয়জন নিজেদের অপরাধ কবুল করলেও প্রশ্ন পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। গতকাল পর্যন্ত কেবল তারা রেলওয়ের এবং গত বছরের শেষের দিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ পরীক্ষার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তাদের প্রত্যাশা, রিমান্ডে এলে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করা সম্ভব হবে।

পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুদকে পিএসসির চিঠি : বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (বিপিএসসি) ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ পাঁচজন গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে পুলিশ। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মঙ্গলবার সাময়িক বরখাস্ত করে পিএসসি। গতকাল তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।

পিএসসির প্রশাসন শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব জামিলা শবনম স্বাক্ষরিত চিঠিটি পিএসসি থেকে দুদকের সচিব বরাবর পাঠানো হয়। অভিযুক্ত পাঁচজন হলেন- উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির এবং পিএসসির কর্মচারী ডেসপাচ রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অবৈধ উপায়ে সংগ্রহ, পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্নপত্র প্রকাশ এবং বিতরণ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী হিসেবে অপরাধ সংঘটনে জড়িত থাকার অভিযোগে কর্মকমিশনের পাঁচ জনসহ অন্যান্যকে আসামি করে পল্টন থানায় মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন কর্মচারী গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে জেলে আছেন। তাছাড়া, তাদের নিজ নামে ও তাদের পরিবারের সদস্যের নামে অসাধু উপায়ে অর্জিত ও তাদের জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দখলে রয়েছেন বা মালিকানা অর্জন করেছেন মর্মে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এভাবে অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা অর্জন দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর তফসিলভুক্ত অপরাধ হওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক তদন্তপূর্বক উপযুক্ত আদালতে বিচারার্থ মামলা দায়ের করার লক্ষ্যে সাক্ষ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাই এসব অভিযোগ তদন্ত করে কমিশনকে অবহিত করতে অনুরোধ করেছে সংস্থাটি।

সর্বশেষ খবর