শিরোনাম
রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

ব্যাংকিং খাতকে আমরা ধরিয়ে দিয়েছি ঘুণে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যাংকিং খাতকে আমরা ধরিয়ে দিয়েছি ঘুণে

ড. আহসান এইচ মনসুর

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ,পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক, ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতকে আমরা ঘুণে ধরিয়ে দিয়েছি। টাকা ছাপিয়ে অচল ব্যাংক সচল রাখা হচ্ছে। আর্থিক দুরবস্থার কারণে দেশ দিনদিন ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও কমছে। সরকার বাজেট বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। এখন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকাও নেই, ডলারও নেই আমাদের কাছে। কীভাবে বাস্তবায়ন হবে? আর্থিক খাতের সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই। গতকাল রাজধানীর পল্টনের ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার কারণ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন এ অর্থনীতিবিদ। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ইআরএফ।  ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। অনুষ্ঠানে ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সমকালের বিশেষ প্রতিবেদক ওবায়দুল্লাহ রনি এবং প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সানাউল্লাহ সাকিব।  ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঋণ আদায় না করে ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে, সরকারও ট্যাক্স পাচ্ছে। বাস্তবে কোনো আয়ই হয়নি। ব্যাংক খাতের আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী, কিছু কিছু পরিবার। সরকারের আশীর্বাদে তারা পুষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের কারণেই এখন আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে কার্পেটের নিচে ময়লা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে অথচ তা লুকিয়ে রাখা যায় না। একটা সময় তা দুর্গন্ধ ছড়াবেই। আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমরা থালাবাটি বেচে কোরমা-পোলাও খাচ্ছি। কিন্তু এ রকম করলে তো আমাদের ব্যাংক টিকবে না। এখন ঋণ আদায় না করেই ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংক। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশও দিচ্ছে। সরকারও ট্যাক্স পাচ্ছে। বাস্তবে ব্যাংকের কোনো আয়ই হয়নি। আমানতের অর্থ লুটে খাওয়া হচ্ছে। এর মানে ঘরের থালাবাটি বেচে কোরমা-পোলাও খাওয়া হচ্ছে। এভাবে আর কতদিন ব্যাংক চলবে- এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, এতে আমানত শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু গ্রাহকের অর্থ আর ফেরত দিতে পারবে না। ব্যাংকে মন্দঋণ, অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ পাচার লুকিয়ে রেখে এ খাতের সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, আমাদের বিদ্যুতের ক্ষেত্রে দুই বিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়েছে। পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। যদি স্বাস্থ্য ভালো না থাকে তাহলে তার ভার বহনও করা যায় না। ব্যাংক খাতের দুর্বলতার কারণে এখন ব্যাংক ব্যক্তি খাতকেও ঋণ দিতে পারছে না। আবার সরকার ঋণ দিতে পারছে না, সরকার পারবেও না। এখন ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। চলতি বছর যদি বাড়ে, তাহলে সেটা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে। সে হিসাবে এ বছর আমানত আসবে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। তাহলে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা কীভাবে দেবে ব্যাংক? সরকার ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলে ব্যক্তি খাত টাকা পাবে না। আবার বাজেটে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি যদি না বাড়ে, সরকারকে যদি ঋণ দিতে হয় তাহলে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কীভাবে অর্জন হবে? তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগে সরকার বলেছিল আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার আনা হবে। ছয় মাস পার হলেও সংস্কারের কিছুই হয়নি। এটা হতাশাজনক। দেশের স্বার্থেই ব্যাংক খাতের সংস্কার জরুরি। আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে, এটাকে ভালো চোখেই দেখি। কিন্তু আমাদের নিজেদের স্বার্থেই ব্যাংক খাত সংস্কার করা দরকার। আমরা ব্যাংকের আমানত খেয়ে ফেলছি। এভাবে ব্যাংক কতদিন চলবে? ব্যাংক খাত নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। সেটা সরকারকেই করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে নয়। ব্যাংক খাতে আজকের এ অবস্থার কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, আর্থিক খাতের ক্লিনিং (পরিষ্কার) করতে হবে। ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো সমাধান না করে জিইয়ে রাখা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ঘরের দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা ঝাড়ু দিয়ে কার্পেটের নিচে রেখে দিচ্ছে। এতে আসলে দুর্গন্ধ দূর হয় না, কোনো না কোনো একদিন আবারও দুর্গন্ধ ছড়াবে। অনিয়মের তথ্য বিভিন্নভাবে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু এসব তথ্য লুকিয়ে রাখার কারণে ব্যাংক খাতের অনিয়মের দুর্গন্ধ পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘ব্যাংকে মন্দ ঋণ, অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ পাচার লুকিয়ে রেখে এ খাতের সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে না। এজন্য আর্থিক খাত পরিষ্কারের (ক্লিনিং) উদ্যোগ নিতে হবে। এ উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকেও থাকবে। এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, শুধু রপ্তানির তথ্য লুকানো হয় কি? সবচেয়ে বেশি তথ্য লুকানো হচ্ছে আর্থিক খাতে। অথচ আর্থিক খাতেই সঠিক তথ্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে খেলাপিঋণ দেখানো হচ্ছে এখন ১১ শতাংশ। বাস্তবে খেলাপি বা মন্দ ঋণ ২৫ শতাংশ। এভাবে আর্থিক খাত বেশি দিন চলতে পারে না। তদারকির অভাবে আমাদের মুদ্রাবাজার হাতছাড়া হয়েছে, মূল্যস্ফীতিও আমাদের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে।

সর্বশেষ খবর