মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

৪০০ কোটির কে এই জাহাঙ্গীর

♦ পিয়ন থেকে হতে চেয়েছেন এমপি-মন্ত্রী ♦ ঢাকা-চট্টগ্রাম নোয়াখালীতে বহুতল ভবন আলিশান ফ্ল্যাট কয়েক শ বিঘা জমি ♦ স্ত্রী-শাশুড়ির নামে সম্পদের পাহাড় ♦ অবশেষে ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ

বিশেষ প্রতিনিধি

৪০০ কোটির কে এই জাহাঙ্গীর

নাম তার মো. জাহাঙ্গীর আলম। ৯০ দশকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে আসা দলীয় নেতা-কর্মীদের পানি খাওয়ানোর কাজ করতেন। সেই থেকে তার নাম হয় পানি জাহাঙ্গীর। নেতা-কর্মীরা তাকে ‘পানি জাহাঙ্গীর’ নামে চিনতেন। পরবর্তীতে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর গণভবনে যাতায়াতের সুযোগ পান। প্রধানমন্ত্রীর কর্মচারী এই পানি জাহাঙ্গীর নিজেকে পরিচয় দিতে থাকেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে। এরপরই যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান পানি জাহাঙ্গীর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিয়ন থেকে তিনি হতে চেয়েছেন এমপি-মন্ত্রী। বাগিয়ে নেন তার নিজ এলাকা নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ। স্ত্রী-শাশুড়িসহ নামে বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ঢাকার মিরপুরে রয়েছে বহুতল ভবন, ধানমন্ডিতে আলিশান ফ্ল্যাট। চট্টগ্রাম কর্ণফুলী টানেলের পাশে ১০০ বিঘা জমি, নোয়াখালীর চাটখিল ও মাইজদিতে রয়েছে বহুতল ভবন ও বিঘার পর বিঘা জমি। ব্যাংকে ডিপোজিট তার কয়েক শ কোটি টাকা। নিজ এলাকায় তিনি যখন যেতেন তার গাড়ির সামনে পেছনে থাকত পুলিশের গাড়ি। সেখানে তার নির্দেশেই চলত পুলিশ ও প্রশাসন। থানার ওসি, টিএনওসহ প্রশাসনের সব রদবদল হতো তার ইশারায়। এমপি থাকলেও পানি জাহাঙ্গীরের কথাই সেখানে ছিল শেষ কথা।

সম্প্রতি চীন সফর নিয়ে গত রবিবার গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমার বাসায় কাজ করা পিয়ন, যে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলেন না। প্রধানমন্ত্রীর এমন পিলে চমকানো তথ্য ফাঁসের পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। ওই পিয়নের পরিচয় খোলাসা না করা হলেও অনুসন্ধানে উঠে আসে সেই পিয়ন পানি জাহাঙ্গীরের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। তার ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়। একাধিক সূত্রের দাবি, তিনি তড়িঘড়ি দেশ ছেড়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি অবস্থান করছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।

এ অবস্থায় জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে তাদের অ্যাকাউন্ট খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সব ব্যাংকে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়েছে।

পানি জাহাঙ্গীরের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার নাহারখিল গ্রামে। তার বাবার নাম রহমত উল্যা ও মায়ের নাম অজিফা খাতুন।

জানা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চার মেয়াদের প্রথম দুই টার্মের পুরোটা এবং তৃতীয় টার্মের প্রথম কিছু দিন প্রধানমন্ত্রীর পারসোনাল এইড হিসেবে কর্মরত ছিলেন জাহাঙ্গীর। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে সরকারের ওই টার্মের প্রথম দিকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চাকরি না থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে তার নামে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নজরে এলে ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। তার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পানি জাহাঙ্গীরের বাবা ইউনিয়ন পরিষদের কেরানি হিসেবে চাকরি করতেন। সংসারে ছিল টানাপোড়েন। দল ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর এ পিয়নের উত্থান অনেকের কাছে আলাদিনের চেরাগের মতো। চাটখিলে পৈতৃক ভিটায় করেছেন চার তলা বাড়ি। বাড়ির পাশে রয়েছে ৭০০ শতক জমি। উপজেলার খিলপাড়া পূর্ব বাজারে রয়েছে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ। জেলা শহরের মাইজদীতে রয়েছে আট তলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল ভবন।

সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারীর চাকরি পাওয়া জাহাঙ্গীর সবসময় নিজেকে ‘প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসেবে পরিচয় দিতেন। এই পরিচয়েই করতেন বিভিন্ন তদবির বাণিজ্য। বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের উদ্বোধনও করেছেন তিনি। এমনকি ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করেন দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছেও। এ পরিচয়ে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার পরিবারের একাধিক সদস্যকেও। জাহাঙ্গীর আলমের ভাই দীর্ঘদিন ধরে খিলপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান। তার ভাগিনা মাকসুদুর রহমান শিপন জেলা পরিষদের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান। দুটি পদই জাহাঙ্গীর আলমের ক্ষমতার জোরে বাগিয়ে নেন বলে জানা গেছে। তার দাপটে তাদের বিরুদ্ধে কেউ নির্বাচনে পর্যন্ত দাঁড়ায়নি। ভাগিনা শিপনও মামার জোরে এলাকায় বেশ দাপুটে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র তোলেন পানি জাহাঙ্গীর। সেটা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। তবে পরবর্তীতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। নোয়াখালী-১ আসনের নৌকার প্রার্থী এইচ এম ইব্রাহীমের বিরোধিতা করেন জাহাঙ্গীর। তাকে হারানোর পাঁয়তারার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

রাজধানীতে একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট রয়েছে জাহাঙ্গীরের। ধানমন্ডিতে তার স্ত্রীর নামে সাড়ে ৫ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট আছে। নোয়াখালীর মাইজদী শহরের হরি নারায়ণপুরে জাহাঙ্গীরের আট তলা বাড়ি রয়েছে। সেটিও তার স্ত্রীর নামে। সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য বিপুল অর্থ খরচ করেন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশাল বহর নিয়ে করতেন সভা-সমাবেশ। বিভিন্ন সময়ে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিজের এলাকায় দাওয়াত করে নিয়ে যান জাহাঙ্গীর। যাতায়াতের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করতেন তিনি। ধানমন্ডিতে আলিশান ফ্ল্যাট ছাড়া মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান রয়েছে তার।

মিরপুরে সাত তলা ভবন ও দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে জাহাঙ্গীরের। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় কৃষিখাত থেকে প্রতি বছর ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে ৯ লাখ টাকা, চাকরি থেকে ৬ লাখ এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা আয়ের তথ্য জানান তিনি। সবমিলিয়ে বছরে তার প্রায় ৫০ লাখ টাকা আয়ের কথা জানানো হয়।

নির্বাচনি হলফনামা অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরের নামে আড়াই কোটি টাকা এবং তার স্ত্রীর নামে ব্যাংকে সোয়া ১ কোটি টাকা রয়েছে। ডিপিএস আছে পৌনে ৩ লাখ টাকা। এফডিআর রয়েছে সোয়া ১ কোটি টাকার। স্ত্রীর নামে বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন জাহাঙ্গীর। বিভিন্ন কোম্পানিতে কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে। এ ছাড়া একটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানে তার ৬ কোটি টাকার বিনিয়োগও আছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পিয়ন হিসেবে কাজ করার সময় ব্যক্তিগত পরিচয় দিয়ে তদবির, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করেন জাহাঙ্গীর। গাজীপুরের ইপিজেড এলাকার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বেড়ানো এই জাহাঙ্গীর তিনটি বিয়ে করেছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি প্রথম স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে ঢাকার ডেমরায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ওই সংসারে আলভি নামে তার এক ছেলে রয়েছে। এরপর আরও একটি বিয়ে করেন তিনি। সেই বিয়েটি হয় নাটকীয়ভাবে। জাহাঙ্গীরের যিনি তৃতীয় স্ত্রী হয়েছেন, তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পেতে সুপারিশের জন্য তার বাবার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের কাছে গিয়েছিলেন। তখন জাহাঙ্গীর তার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন এবং বিয়ে করে ফেলেন।

সর্বশেষ খবর