মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশ্ন

নিজেদের রাজাকার বলতে লজ্জা হয় না

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজেদের রাজাকার বলতে লজ্জা হয় না

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দেওয়ায় তা অত্যন্ত দুঃখজনক আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও লাগে না।

গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ‘বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) সই’ এবং ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী কীভাবে দেশে অত্যাচার চালিয়েছে তা তারা জানে না। এসব অত্যাচার, রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকা এরা দেখেনি। তাই নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাবোধ হয়নি। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হচ্ছে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। লাখো শহীদ রক্ত দিয়ে গেছেন, লাখো মা-বোন নির্যাতিতা, তাদের এই অবদান ভুললে চলবে না। পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকার বাহিনী যেভাবে এ দেশে অত্যাচার করেছে সেখানে আমার খুব দুঃখ লাগে যখন শুনি রবিবার রাতে রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও বলে তারা রাজাকার। তিনি বলেন, তারা কি জানে ’৭১ সালের ২৫ মার্চ কী ঘটেছিল সেখানে। সেখানে ৩০০ মেয়েকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা। ৪০ জন মেয়েকে পাকিস্তানি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছিল। তারা সেখানে কী অবস্থায় ছিল? অনেক মেয়ে শাড়ি বা ওড়না দিয়ে ফাঁসি দিয়েছিল। তাদের কাপড় পরতে দেওয়া হতো না, একটা পেটিকোট পরিয়ে বসিয়ে রাখত। দিনের পর দিন তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাত। সরকারপ্রধান বলেন, যখন তাদের উদ্ধার করা হয় মিত্র শক্তির এক ভারতীয় শিখ সৈন্য নিজের মাথার পাগড়ি খুলে এক মেয়ের গায়ে পরিয়ে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এটা কেবল একটা ঘটনা, এরকম বহু ঘটনা রয়েছে। শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান তুলে ধরে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মেয়েরা বসে থাকেনি। পিরোজপুরে এক মেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর রান্নার কাজ করত এবং রাতে নদী সাঁতরে পার হয়ে চিতলমারী গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে হানাদারদের খবর পৌঁছে দিত। ধরা পড়ার পর দুটো গাড়ির সঙ্গে তার দুই পা বেঁধে টেনেহিঁচড়ে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলা হয়। এসব অত্যাচার, রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকা এরা দেখেনি। তাই নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জা হয় না। তিনি বলেন, হ্যাঁ আমাদের গেরিলা যুদ্ধ হয়েছে। এখানে কেউ শান্তি কমিটিতে ছিল কিন্তু মানুষের ক্ষতি করেনি। কিন্তু যে বাহিনীগুলো পাকিস্তানি হানাদাররা তৈরি করে তাদের হাতে অস্ত্র দিয়েছিল এবং তাদের দিয়ে মানুষের ক্ষতি করতে অত্যাচার, লুটপাট এবং গণহত্যা চালাত, তাদের বিরুদ্ধেই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি, তাদের বিচার করে অনেকের ফাঁসিও দিয়েছি। এর মাধ্যমে তাদের দ্বারা যারা নির্যাতিত তারা ন্যায়বিচার পেয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। জাতির পিতার একটি ডাকে এ দেশের মানুষ ঘরবাড়ি, পরিবার-পরিজন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে রণক্ষেত্রে চলে গেছে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করে বিজয় এনে দিয়েছে। আর যারা রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীতে ছিল এবং দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছি। আর এই দুর্নীতি ধরতে গেলে সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমি এটা বিশ্বাস করি না। দুর্নীতি খুব কম লোকই করে, কিন্তু তার বদনাম হয় খুব বেশি। তিনি বলেন, যারাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের কী বদনাম হবে না হবে সেটা আমি পাত্তা দিই না। কোনো মতেই আমি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেব না।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আপনাদের কাছে আরেকটা অনুরোধ, পত্র-পত্রিকায় কী লিখল, সেটা দেখে নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই, ঘাবড়ানোরও কিছু নেই। বরং দেখবেন এর কোনো সত্যতা আছে কি না? যদি না থাকে পত্রিকা সোজা ডাস্টবিনে ফেলে দেবেন। ওইটা পড়ারও দরকার নেই। এটা হলো আপনাদের কাছে আমার পরামর্শ। তিনি বলেন, আমি নিজেও অনেক পত্রিকা পড়ি না। কেন? দেশটা আমার, আমি দেশটাকে ভালোভাবে চিনি, জানি। সেই ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জন্ম নিয়েছি জাতির পিতার ঘরে, এই দেশের কীভাবে ভালো হয়, মন্দ হয় সেটা আমাদেরই জানার কথা বেশি। আমাদের থেকে বেশি আর কেউ জানতে পারে না। তিনি আরও বলেন, আপনারাও দেশের পরিচালক। আমরা পাঁচ বছরের জন্য আসি। আপনারা স্থায়ী সময় নিয়ে আসেন। আমরা দেশের মাটি ও মানুষের কথা চিন্তা করে, রাজনীতি করে এতদূর এসেছি।

সরকারপ্রধান বলেন, হঠাৎ করে অস্ত্র হাতে ক্ষমতা দখল করে কিংবা টেলিভিশনে ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় আসিনি। দেশের প্রতিটি ইঞ্চি, মাটি ও মানুষ আমার চেনা। দেশের উন্নয়ন করাই আমাদের লক্ষ্য। সেটা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কে কী লিখল সেটাতে ঘাবড়ে যাওয়া, সেটা নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করা উচিত নয়।

প্রধানমন্ত্রী এই সময় প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করলে দ্রুত সম্পন্ন হবে এবং অর্থনীতিতে অবদান রাখবে এবং মানুষের উপকার হবে সে ধরনের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং অসমাপ্ত প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। পাশাপাশি অপচয় রোধ, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং কৃচ্ছ্রসাধনেরও আহ্বান জানান তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিজেদের আত্মবিশ্বাস ও বিবেক, বিবেচনা নিয়েই দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সবাইকে নজরদারি রাখার পাশাপাশি চক্রান্ত করে কেউ যেন খাদ্যের দাম বাড়াতে না পারে সেদিকে সজাগ থাকার জন্যও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদান করেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্যও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেন।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। স্বাগত বক্তৃতা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। এপিএ কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনায় শীর্ষস্থান অর্জনকারী বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান এবং শুদ্ধাচার পুরস্কার লাভকারী শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাহবুব হোসেন নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন।

 

সর্বশেষ খবর