মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাজাকার স্লোগান ঘিরে বিতর্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক

রবিবার মধ্যরাতে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে, আমি কে/রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছেন নিজেদের ক্যাম্পাসগুলোতে। নিজেকে রাজাকার দাবি করে দেওয়া এই স্লোগান নিয়ে দেশজুড়ে চলছে সমালোচনার ঝড়। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের এ ধরনের স্লোগান পরিণত হয়েছে টক অব দ্য কান্ট্রিতে। ইতিহাসবিদরা বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগীদের বলা হয় রাজাকার। একাত্তরের মে মাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা দিতে গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী। বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্য লড়াইরত মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরোধে খুলনায় খানজাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন পাকিস্তানপন্থি কর্মী নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। পরে দেশের অন্যান্য অংশেও গড়ে তোলা হয় এই বাহিনী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী নৃশংসতার সমার্থক এই রাজাকার বাহিনী। বাংলাদেশের মানুষ এ নামটি উচ্চারণ করে ঘৃণার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রাজাকাররা। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশের শিক্ষার্থীরা আজ ৫৩ বছরে এসে নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে আখ্যায়িত করাকে কীভাবে দেখেন- জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসে ছাত্ররা নিজেদের রাজাকার দাবি করে স্লোগান দেবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে অন্যান্য আন্দোলনে আজ পর্যন্ত ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছে। দেশের স্বাধীনতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেক ভূমিকা। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এমন স্লোগান আমাদের ব্যথিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত বিষয়টি কঠোরভাবে দেখা।’ গত রবিবার চীন সফরের বিষয় তুলে ধরতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? তাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? এটা আমার দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন।’ এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ওইদিন রাত ১০টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে সমস্বরে ‘তুমি কে, আমি কে/রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। এরপর একে একে রাত ১১টার দিকে বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমবেত হন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। এ সময় শিক্ষার্থীদের আরও কিছু স্লোগানের মধ্যে ছিল ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।’ ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’। ‘লেগেছে রে লেগেছে রক্তে আগুন লেগেছে,’। ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’। ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’। ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে’ প্রভৃতি স্লোগান দেন। একই সময়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এ ধরনের স্লোগানে বিক্ষোভ করেন ওই রাতে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারপ্রধানের কথার প্রতিবাদ করা, প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার দেশের নাগরিকদের রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যৌক্তিক। আমি তাদের আন্দোলনকে সমালোচনা করব না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এ ধরনের স্লোগান কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না’। ইউজিসির সাবেক এই চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আবেগের জায়গা থেকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছেন, শিক্ষার্থীরাও আবেগের অনুভূতিতে রাতভর মিছিল করেছে। কিন্তু মিছিলে রাজাকার স্লোগান কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, ২ লাখ মা-বোনের সম্মানের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা। রাজাকারদের অত্যাচারে শ্মশানে পরিণত হয়েছিল এই বাংলাদেশ। তাই এ ধরনের স্লোগান গ্রহণযোগ্য নয়।’ কোটা আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের স্লোগান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী দীপু মনি লেখেন, ‘যারা নিজেদেরকে রাজাকার বলে পরিচয় দেয়, তাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তস্নাত লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বা সে পতাকা কপালে বেঁধে নিয়ে মিছিল করবার কোনো অধিকার থাকতে পারে না।’ এসব স্লোগানের প্রতিবাদে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, ‘তুমি কে- আমি কে?/বাঙালি, বাঙালি। তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা-মেঘনা-যমুনা।’ ‘একাত্তরের হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার’। ‘তোরা যারা রাজাকার/এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ এই স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

 

সর্বশেষ খবর