শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী

রায় পর্যন্ত ধৈর্য ধরুন হতাশ হতে হবে না

নিজস্ব প্রতিবেদক

রায় পর্যন্ত ধৈর্য ধরুন হতাশ হতে হবে না

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস, আমাদের ছাত্রসমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না।

বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। আট মিনিট ছয় সেকেন্ডের ভাষণে আন্দোলন ঘিরে হত্যাকাণ্ড ও সব অনভিপ্রেত ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের আপিল করার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদালতে শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। আদালত শিক্ষার্থীদের কোনো বক্তব্য থাকলে শোনার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এই আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের সুযোগ রয়েছে। এই আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় আন্দোলনে নেমে দুষ্কৃতকারীদের সংঘাতের সুযোগ তৈরি করে দেবেন না। হামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি, যারা হত্যাকা  ও লুটপাট, সন্ত্রাসী কর্মকা  চালিয়েছে এরা যেই হোক না কেন তারা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায়, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি আরও ঘোষণা করছি হত্যাকা সহ যেসব অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে সেসব বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হবে। তিনি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় নিহতের জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৮ সালে ছাত্রসমাজের আন্দোলনে পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিল করে একটা পরিপত্র জারি করে। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে কোটা বহাল রাখার পক্ষে উচ্চ আদালত ২০১৮ সালের জারি করা সরকারের পরিপত্র বাতিল করে দেন। সরকারের পক্ষ থেকে পরিপত্র বহাল রাখার জন্য সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা হয় এবং মহামান্য আদালত শুনানির দিন ধার্য করে। এ সময় আবার ছাত্ররা কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের শুরু থেকেই সরকার যথেষ্ট ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শন করেছে। বরং আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পুলিশ সহযোগিতা করে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যখন আন্দোলনকারীরা স্মারকলিপি প্রদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, সে ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ করে দেওয়া হয় এবং নিরাপত্তারও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সরকারপ্রধান বলেন, দুঃখের বিষয় হলো এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাদের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য ও সন্ত্রাসী কর্মকা  শুরু করে। যেহেতু বিষয়টি উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়েছে তাই সবাইকে ধৈর্য ধরতে আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো কিছু মহল এ আন্দোলনের সুযোগটা নিয়ে অনাকাক্সিক্ষত উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করবার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাে  লিপ্ত হয়। এর ফলে, এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা খুবই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। অহেতুক কতগুলো মূল্যবান জীবন ঝরে গেল। আপনজন হারাবার বেদনা যে কতটা কষ্টের তা আমার থেকে আর কে বেশি জানে?

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আমি প্রতিটি হত্যাকাে র নিন্দা জানাই। যেসব ঘটনা ঘটেছে তা কখনই কাম্য ছিল না। চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীরা বহুতল ভবনের ছাদ থেকে ছাত্রদের হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে নিচে ছুড়ে ফেলে এবং অনেক ছাত্রের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। তাদের ওপর লাঠিপেটা এবং ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে, একজন মৃত্যুবরণ করেছে, অনেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। ঢাকা, রংপুর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবন ও ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হলে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর করা হয়। তিনি আরও বলেন, সাধারণ পথচারী, দোকানিদের আক্রমণ, এমনকি রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স চলাচলে বাধা প্রদান করা হয়। মেয়েদের হলে ছাত্রীদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে এবং লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। আবাসিক হলে প্রভোস্টদের হুমকি দেওয়া ও আক্রমণ করা হয়েছে। শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়ে তাদের গায়ে হাত তোলা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বিশ্বাস করি যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত তাদের সঙ্গে এসব সন্ত্রাসীদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সন্ত্রাসীরা এদের মধ্যে ঢুকে সংঘাত ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। যারা হত্যাকাে র স্বীকার হয়েছে তাদের পরিবারের জন্য জীবনজীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে যে সহযোগিতা দরকার তা আমি করব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি দ্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি, যারা হত্যাকা , লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকা  চালিয়েছে এরা যেই হোক না কেন, তারা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি আরও ঘোষণা করছি, হত্যাকা সহ যেসব অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, সুষ্ঠু বিচার ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে সেসব বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হবে। কাদের উসকানিতে সংঘর্ষের সূত্রপাত হলো, কারা কোন উদ্দেশ্যে দেশকে একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিল, তা তদন্ত করে বের করা হবে।

আন্দোলনরত কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সন্ত্রাসীরা যে কোনো সময়ে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে তাদের ক্ষতিসাধন করতে পারে। তাই শিক্ষার্থীদের পিতামাতা, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের প্রতি আমার আবেদন থাকবে, তারা যেন তাদের সন্তানদের নিরাপত্তার বিষয়ে সজাগ থাকেন। একই সঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে নজর রাখেন।

এর আগে বক্তব্যের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হিজরি ৬১ সালের পবিত্র এই দিনে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন ও তার পরিবারের সদস্যরা শহীদ হয়েছিলেন। আমি তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলার মাটিতেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে আরেক কারবালা বাংলার মাটিতে সৃষ্টি হয়েছিল। যারা শাহাদাতবরণ করেছেন, আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ নির্যাতিতা মা-বোনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

শেখ হাসিনা বলেন, আজকে অত্যন্ত বেদনা-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের অর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছি। বিগত ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ব্যবহার এবং মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষার ব্যবস্থা করে জনগণকে উন্নত জীবন দেওয়ার যাত্রা শুরু করেছি। অনেক সাফল্যও অর্জন করেছি। বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে একটা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি। তার পরও আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ যখন একটু স্বস্তি-শান্তিতে ফেরে, তখন মাঝেমধ্যে এমন কোনো ঘটনা ঘটে যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের আহ্বান : গতকাল সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ব্লু ইকোনমি’কে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য বিস্তীর্ণ সমুদ্র এলাকায় সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে বিনিয়োগের জন্য বিদেশি ও স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মাছের রপ্তানি বাড়াতে মাছের সংগ্রহ, বিতরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে যথাযথ মান বজায় রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেন। কারণ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হবে মাছ।

‘বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড সি-ফুড শো-২০২৪’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি একথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, যারা বিনিয়োগকারী তাদেরও আমরা আহ্বান জানাব। কারণ, আমাদের সমুদ্র সম্পদকে ব্যবহার করে ‘ব্লু ইকোনমি’কে আরও সমৃদ্ধশালী আমরা করতে পারব। সি-উইড, শামুক, ঝিনুক, মুক্তা প্রভৃতি আহরণ এবং সমুদ্রের পানি থেকে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি সমুদ্রের পানি থেকে বিদ্যুৎ, হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি উৎপাদনেও গবেষণা চলছে। ইনশাল্লাহ আমরা সেটাও করতে পারব।

সরকারপ্রধান বলেন, সমুদ্র সম্পদের বহুমুখী ব্যবহার আমাদের অর্থনীতি ‘ব্লু ইকোনমি’কে আমরা আরও সমৃদ্ধশালী করতে পারব। সে ক্ষেত্রে আমি আশাকারি যারা বিনিয়োগকারী, যারা বাংলাদেশে এসেছেন বা যারা আমাদের দেশি বিনিয়োগকারী, আপনারা যৌথভাবে এ বিনিয়োগের ক্ষেত্র আবিষ্কার করে এখানে আরও বিনিয়োগ করতে পারেন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আবদুর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শ ম রেজাউল করিম ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ মাহমুদ বেলাল হায়দার স্বাগত বক্তৃতা করেন।

জার্মানভিত্তিক প্লানকোয়াডর‌্যাটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মার্টিন গেসকেস এবং বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। আলোচনা পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রী ‘অ্যাকুয়া কালচার ও সি-ফুড শো’-এর বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর