শনিবার, ২০ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

বিক্ষোভ সংঘাতে নিহত ৪৭

রাজধানীজুড়ে দিনভর সংঘর্ষ, গুলি, আগুন, টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা, মহাখালী সেতু ভবন ও এক্সপ্রেসওয়েতে আবারও আগুন

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিক্ষোভ সংঘাতে নিহত ৪৭

রাজধানীর রামপুরায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবিতে সড়ক অবরোধ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে গতকাল ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে কোটাব্যবস্থা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মধ্যে এ সংঘর্ষে ব্যাপক গুলি, টিয়ার গ্যাস, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও অগ্নিসংযোগ ঘটে। কোনো কোনো স্থানে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ জড়িয়ে পড়লে ত্রিমুখী সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলিবর্ষণ, টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড বোমা ব্যবহার করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব সংঘর্ষে শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, পুলিশসহ ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকাতেই মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের। এ ছাড়া সিলেটে একজন, রংপুরে পাঁচজন, নরসিংদীতে একজন, মাদারীপুরে দুজন, বগুড়ায় একজন, সাভারে দুজন এবং নারায়ণগঞ্জে দুজন রয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন সহস্রাধিক ব্যক্তি। সংঘর্ষ চলাকালে রাজধানীর উত্তরা, নতুনবাজার, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, রামপুরা, লক্ষ্মীবাজার, নয়াপল্টন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপে এসব এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় কাটায়। এ সময় রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। রামপুরা থানায় আগুন দেওয়া হয়। রামপুরা টেলিফোন ভবন এবং বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলের পাশে পুলিশবক্সে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বনানীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, সেতু ভবনের অর্ধশতাধিক গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।

সংঘর্ষ চলাকালে যাত্রাবাড়ীতে চারজন, বাড্ডায় তিনজন, রামপুরায় একজন, নয়াপল্টনে একজন, লক্ষ্মীবাজারে একজন এবং যাত্রাবাড়ীতে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা যোগ দিলে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়।

গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ২২টি লাশ পাঠানো হয়। এরা প্রত্যেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিরা হলেন বাড্ডায় স্যানিটারি মিস্ত্রি গনি শেখ (৪০), রামপুরা ব্রিজে বিদ্যুৎ অফিসের কর্মচারী গোলাম রাব্বি রাকিব (২৭), বাড্ডা লিঙ্ক রোডে ডেলিভারিম্যান সোহাগ (১৯), যাত্রাবাড়ীতে রবিউল (৩০), একই এলাকার কুতুবখালীতে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি। তার বয়স আনুমানিক ২০। রায়েরবাগে ইলেকট্রিক দোকান মালিক মোবারক (৩২) ও ইমন (২৫), যাত্রাবাড়ীর কাজলায় হোটেল কর্মচারী আরিফ (১৮) ও শান্ত (২০), নয়াপল্টনে পাভেল (২৫), বাড্ডা-শাহজাদপুরে অজ্ঞাত আরেক ব্যক্তি, তার বয়স আনুমানিক ১৮। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে সরকারি কবি নজরুল কলেজের ইসলামের ইতিহাসের ছাত্র ওমর ফারুক (২৩), শনিরআখড়ায় মারা যান একই কলেজের জিহাদ (২২) নামে আরেক ছাত্র, মিরপুর-১০-এ আবু তালেব স্কুলের সামনে রাব্বি (২৭), নিউমার্কেট চায়না বিল্ডিংয়ের সামনে ওয়াদুদ (৪০), শাওন (২৫), শুভন (২৫), একই এলাকায় অজ্ঞাত আরেক ব্যক্তি, তার বয়স আনুমানিক ২০। মিরপুর-১০-এ মামুন (২৭), রামপুরা ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে মারুফ (২৫), দৈনিক বাংলা মোড়ে আনসার সদস্য জুয়েল (৩৫) এবং বছিলায় মনসুর (৪০)। এ ছাড়া সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে চারজনের লাশ পাঠানো হয়। এরা হলেন কদমতলীতে নিহত রুহান (২২), যাত্রবাড়ীতে রাসেল (২০) এবং অজ্ঞাত দুজন। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ীতে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন বলে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি আবুল হাসান জানিয়েছেন।

গতকাল সকাল থেকে মিরপুর-১০, মোহাম্মদপুর, বছিলা, পল্টন, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, কাজলা, রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা, মহাখালী, গুলশান, উত্তরা, যমুনা ফিউচার পার্ক, মগবাজার, মালিবাগ এলাকায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলিবর্ষণ ও টিয়ার গ্যাস এবং সাউন্ড বোমা ব্যবহার করে। আজমপুর রেললাইন ও মহাখালী রেললাইনের নিয়ন্ত্রণ নেন আন্দোলনকারীরা। আজমপুর রেললাইনের ওপর আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।

সকাল থেকে যাত্রাবাড়ী মোড়, শনিরআখড়া, কাজলা, রায়েববাগ এলাকায় শিক্ষার্থীরা জড়ো হন। তারা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে যাত্রাবাড়ী রণক্ষেত্র পরিণত হয়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাটও। একদিকে শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে পুলিশের মোকাবিলা করেন, অন্যদিকে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল ও গুলিবর্ষণ করে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন মাদরাসাছাত্র, রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও যোগ দেন। সংঘর্ষে একজন পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজন নিহত হন।

বৃহস্পতিবার থেকেই বাড্ডা, বনশ্রী ও রামপুরায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশসহ আশপাশের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়ো হন। তারা বিটিভিসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন দেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। সারা রাত অবস্থান করেন। গতকাল সকাল থেকে তারা এসব এলাকায় অবস্থান নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। এতে ওই এলাকা রণক্ষেত্র পরিণত হয়। রামপুরা থানায় আগুন, বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলের পাশে পুলিশবক্সে আগুন, রামপুরা টেলিফোন ভবনে আগুন দেওয়া হয়। রামপুরা ব্রিজ, লিঙ্ক রোড, বাড্ডা ইউলুপ এলাকায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। সংঘর্ষে বাড্ডায় তিনজন ও রামপুরায় একজন নিহত হন।

গতকাল জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম, পল্টন মোড়, জাতীয় প্রেস ক্লাব, বিজয়নগর ও নয়াপল্টনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী এবং মুসল্লিদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ওই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল ও গুলি বর্ষণ করে। পাঁচ ঘণ্টা ধরে থেমে থেমে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভীকে আটক করা হয়। সংঘর্ষে একজন নিহত হন।

সকাল থেকে মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন এলাকায় থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছে। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, বছিলা, শিয়া মসজিদ, তাজমহল রোড, নুরজাহান রোড, সলিমুল্লাহ রোডে সংঘর্ষ ঘটে। বিভিন্ন জায়গায় আগুন দেওয়া হয়। পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল ও গুলি বর্ষণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। উভয় পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ অনেকে আহত হয়েছেন। আন্দোলনকারীরা বলছেন, হেলিকপ্টর থেকে তাদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল ও গুলি বর্ষণ করা হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দাগি আসামি, ছিনতাইকারী, নেশাখোররা যুক্ত হয়েছে।

সকাল থেকেই উত্তরায় অবস্থান নেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষ ঘটে। আজমপুর বিএনএস সেন্টারের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন। পরে তারা হাউস বিল্ডিং, রাজলক্ষ্মী, জসীমউদ্দীন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তারা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। দোকানপাট, শপিং মল বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান আন্দোলনকারীরা। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আজমপুর রেললাইন অবস্থান নেয়। সেখানে তারা আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে উত্তরার সেক্টর-৪ ও ৬ এবং রেললাইনের আশপাশ এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমসহ অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছেন।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় সারা দেশে ৩ শতাধিক প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ৭৫ প্লাটুন। বিটিভির নিরাপত্তায় রয়েছে ১১ প্লাটুন। কমপ্লিট শাটডাউনে দায়িত্ব পালনকালে সহিংসতাকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে সারা দেশে বিজিবির ৫২ সদস্য আহত হয়েছেন এবং একাধিক গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর