রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
হাসপাতালে আহতদের দেখলেন প্রধানমন্ত্রী

অর্থনীতি পঙ্গু ও ভিক্ষুকের জাতি করতেই সহিংসতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

অর্থনীতি পঙ্গু ও ভিক্ষুকের জাতি করতেই সহিংসতা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল পঙ্গু হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান । ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা পরিদর্শন করেন -পিআইডি

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যারা আহত হয়েছেন তাদের দেখতে গতকাল সকালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন-নিটর (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ সময় আহতদের চিকিৎসার জন্য যা যা করণীয় সরকার তা করবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যারা আহত তাদের সবার চিকিৎসা সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য যা যা লাগবে আমরা করে দেব, করে দিচ্ছি। যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছে তাদের প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, যারা পা হারিয়েছে, হাত হারিয়েছে, আমরা কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করে দেব। যাতে তারা আবার সুস্থ মানুষের মতো চলতে পারে, নিজের কাজ করতে পারে। এর আগে হাসপাতালে ভর্তি আহতদের রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। সঠিক চিকিৎসার জন্য সরকার পাশে থাকবে বলে তাদের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সংঘাতময় পরিস্থিতির পেছনে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র ছিল বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মনে হলো এটা আর কিছু না। আমাদের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দিয়ে বাংলাদেশকে আবার ভিক্ষুকের জাতি করে দেওয়া। এটাই বোধ হয় এর পেছনে ষড়যন্ত্র। সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে দুঃখজনক।

শেখ হাসিনা বলেন, দেশবাসীর কাছে আমি বিচার চাই, অপরাধটা কী করেছি। যেখানে আমি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছি, মানুষের জীবন মানোন্নয়ন করেছি, আজকে ২০০৮ সালের বাংলাদেশ আর ২০২৪-এর বাংলাদেশ তো এক না। বাংলাদেশের মানুষের জীবন মান তো উন্নত হয়েছে। আমাদের অর্থনীতি আজকে কত ওপরে উঠে গিয়েছিল। তিনি বলেন, দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যখন বাংলাদেশকে একটা জায়গায় নিয়ে এলাম, আজকে সেখানে দেখি, একদিকে জ্বালাও-পোড়াও সবকিছু, ঠিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে সেবা দেয় সেখানে।  জনগণের সহযোগিতা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে মেট্রোরেলে মানুষ কত অল্প সময়ের মধ্যে কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারত, আবার ফিরতে পারত। সেই স্টেশনগুলো পুড়িয়ে এখন ট্রাফিক জ্যাম, মানুষের কষ্ট। আমি তো কষ্ট লাঘব করেছি। কিন্তু যারা এভাবে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষকে আবার কষ্টে ফেলে দিল তাদের বিচার এ দেশের মানুষকেই করতে হবে। আমি খালি সবার সহযোগিতা চাই।  তিনি বলেন, আমার কি এটাই অপরাধ যে, আমি মানুষের জীবনমান উন্নত করার জন্য কাজ করেছি। আর সেই জায়গাগুলোতেই হামলা করতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, যেসব ঘটনা ঘটেছে, আর যেভাবে মানুষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং যারা মারা গেছে আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তিনি বলেন, আজকে এতগুলো মানুষের জীবনের ক্ষতি হলো, এতগুলো পরিবারের ক্ষতি হলো, এর দায়দায়িত্ব কাদের। তাদের বিচার এই দেশের মানুষের করতে হবে। সাম্প্রতিক সংঘাতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির দায়দায়িত্ব কার- এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, কোটা তো আমি বাতিলই করে দিয়েছি। আমি আহ্বান করেছিলাম একটু ধৈর্য ধরো। হাই কোর্টে শুনানি হবে, হাই কোর্ট যে রায় দেয়। না তার পরও এই আন্দোলন, আজকে এতগুলো মানুষের জীবনের ক্ষতি হলো, এতগুলো পরিবারের ক্ষতি হলো। এর দায়দায়িত্ব কাদের। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি দেশবাসীর কাছে সেই আহ্বান জানাব, এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ, এ দেশকে নিয়ে যেন আর কেউ চালাতে না পারে। আমি সবার সাহায্য চাই।

সাম্প্রতিক সংঘাতে যারা মারা গেছে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে আবেগাপ্লুত শেখ হাসিনা বলেন, আর এভাবে মায়ের কোল খালি হোক এটা আমি চাই না। কারণ আমি তো বাবা-মা সব হারিয়েছি, আমি তো জানি হারাবার ব্যথা কত কষ্টের।  প্রধানমন্ত্রী বলেন, (স্বজন হারানোর) কষ্ট বুকে নিয়েই তো ফিরে এসেছি এ দেশের মানুষের জন্য। এখানে আমার তো কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি তো ছেলেমেয়ের জন্যও কিছু করিনি। শুধু তাদের লেখাপড়া, নিজেরাই চাকরি করেছে, নিজেরাই লেখাপড়া করেছে, আমি কতটুকু করতে পেরেছি। কিন্তু আমি দেশের মানুষের জন্য করেছি। তিনি বলেন, আজকে অন্তত মানুষের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, তাদের কাজের সংস্থান, সবই তো করে দিচ্ছিলাম। যখন আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি তখনই এই তান্ডব করে যে জায়গাগুলোতে মানুষের সেবা সেই জায়গাগুলোতেই আঘাত।

বিভিন্ন দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, কোটা আন্দোলনকারীদের কমপ্লিট শাটডাউন আর তার ফলাফল আজকের এই অবস্থা। সব দাবি মেনে নেওয়ার পরও তাদের আর সেই শাটডাউন শেষ হয় না। কী কারণে আমি বুঝি না। আমরা তো সম্পূর্ণ দাবিই মেনে নিয়েছি। তিনি বলেন, একটা মানলে আরেকটা, আরেকটা মানলে আরও একটা। এর ফল আজকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সব দিকে ছারখার। আর আজকে কত মানুষ জীবন হারাল। কত মানুষ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটও এ রকম তান্ডব চালিয়েছিল বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সংঘাতে গুরুতর আহত চিকিৎসাধীন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। আহতদের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবেগাপ্লুত হতে দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী আহত ব্যক্তিদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। নিটর পরিচালক অধ্যাপক ড. কাজী শামীম উজ্জামান আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান। পরে প্রধানমন্ত্রী ভাঙচুর ও অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ভবন, দুর্যোগ ভবন এবং এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজা পরিদর্শন করেন।

মেট্রোস্টেশন চালু করতে জাপানের সহযোগিতা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী : সাম্প্রতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত মিরপুর-১০ নম্বর এবং কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশন দ্রুত চালু করতে জাপানের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে এ অনুরোধ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।

জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রথমে তারা মেট্রোরেল স্টেশন দুটোর ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করবেন এবং তার পর সিদ্ধান্ত নেবেন এই মেট্রোস্টেশন দুটো চালু করতে কীভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করা যায়। তিনি বলেন, মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার পেছনে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। যেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষ এর সুবিধাভোগী। জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেন, বহু মানুষের ঘাম এবং চোখের জলে এই মেট্রোরেল নির্মিত হয়েছে। কিমিনোরি বলেন, মেট্রোরেল স্টেশনগুলোর ক্ষয়ক্ষতি দেখে তিনি আহত হয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক দেশব্যাপী সংঘাতে হতাহতের ঘটনায় সমবেদনা প্রকাশ করেন ইওয়ামা কিমিনোরি।

বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ধ্বংসের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের কল্যাণ, নিরাপত্তা এবং সেবা প্রদানের জন্য নির্মিত বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে দুর্বৃত্তরা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান জনগণের জন্য উপকারী আক্রমণকারীরা সেসব প্রতিষ্ঠান টার্গেট করে। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি বলেন, গত ১৫ বছর নিরলস প্রচেষ্টায় এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।

জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেন, আগস্টের শেষ ভাগে টোকিওতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া পাবলিক প্রাইভেট ইকোনোমিক সংলাপের জন্য তার দেশের ব্যবসায়ীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সংলাপের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন কিমিনোরি। সৌজন্য সাক্ষাতে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

সর্বশেষ খবর