সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার - হাসানুল হক ইনু

রাজনৈতিক বিষয় রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা, আমলা দিয়ে নয়

ক্যাম্পাসে কোনোভাবেই পুলিশ রাখা উচিত নয়

রফিকুল ইসলাম রনি

রাজনৈতিক বিষয় রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা, আমলা দিয়ে নয়

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, কোটা আন্দোলনকারী, সরকার, সর্বোচ্চ আদালতের অবস্থান খুবই কাছাকাছি, আকাশ পাতাল পার্থক্য ছিল না। কোটা আন্দোলনের দাবি সংলাপের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য ছিল। সরকার, প্রশাসন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কেন এটা সমাধান করলেন না এবং করতে পারলেন

না সেটা আমার বোঝার ক্ষমতার বাইরে। রাজনৈতিক বিষয় রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়, আমলা দিয়ে করতে নেই। কোটা আন্দোলন প্রমাণ করল কালক্ষেপণের নীতিটা ভুল ছিল। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলন, সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা, সরকারের করণীয়, আগামীর জন্য কী করণীয়, নিহতদের পরিবারের দায়িত্ব ও আহতদের যথাযথ চিকিৎসাসহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন মহাজোট সরকারের সাবেক এই তথ্যমন্ত্রী।

হাসানুল হক ইনু বলেন, কোটা আন্দোলন প্রমাণ করল ক্যাম্পাসের ভিতরে অহেতুক পুলিশের ভূমিকা সঠিক ছিল না। একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সহিংস আন্দোলনে রূপ দেওয়ার জন্য জামায়াত-শিবির এখনো তৎপর সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, যারা বলেছিলেন, জঙ্গি, জামায়াত-শিবির দুর্বল হয়ে পড়েছে, তারা সঠিক কথা বলেননি। জামায়াত-শিবির আবার ফণা তুলতে চায়। সহিংস আন্দোলনে রূপ দিয়ে বিএনপি-জামায়াত আবার ক্ষমতা দখলে তৎপর রয়েছে। কোটা আন্দোলনে প্রমাণ হলো এলাকাভিত্তিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা। তারা আন্দোলন-সহিংসতা রুখে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ইনু বলেন, সবকিছু থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। প্রশাসনে যেমন সংস্কার প্রয়োজন, তেমনি রাজনৈতিক দলেও সংস্কার প্রয়োজন। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিএনপি-জামায়াতের দুরভিসন্ধি নিয়ে আলোচনা করব, কিন্তু সতর্কতার ঢাল থাকবে না, সেটা হতে পারে না। কিছুদিন ধরে সতর্কতার ঢাল নামিয়ে রাখা হয়েছিল। যে কারণে বিপদ এসেছে। বাংলাদেশকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে। কোনো অবস্থায় সাংবিধানিক ধারা, গণতান্ত্রিক ধারাকে বানচাল করতে দেওয়া যাবে না। দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে।

জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, বিএনপি-জামায়াতসহ কতিপয় ব্যক্তিবর্গ, কোটা আন্দোলনকে বলিষ্ঠভাবে সমর্থন করেছেন। কোটা আন্দোলন ঘিরে যখন সহিংসতার ঘটনা ঘটতে থাকল, রাষ্ট্রের স্থাপনা যখন ধ্বংস করা হলো, কোটা আন্দোলনের সমর্থকরা রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ধ্বংসের নিন্দা জানালো না। তারা নীরবতা পালন করল। এটা রহস্যজনক আচরণ। অতীতেও এমন ঘটেছে। এর মাধ্যমে তারা কার্যত সহিংসতাকে সমর্থন করল। বিএনপি-জামায়াত এ সহিংস আন্দোলনে ধোয়া তুলসী পাতা নয়। প্রমাণ করল বিএনপি জামায়াত ঘোলা জলে এখন মাছ শিকার করতে চায়। তারা দেশের ভালো চায় না। কোটা আন্দোলন সমাধান করতে কেন কালক্ষেপণ করা হলো প্রশ্ন রেখে আওয়ামী লীগের শরিক দলের নেতা ইনু বলেন, কেন কালক্ষেপণ করা হলো? কেন ক্যাম্পাসের ভিতরে ছাত্রদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনা ঘটল? কেন ছাত্রলীগকে সংঘর্ষে জড়িয়ে ফেলা হলো সেটাও আমার বোঝার বাইরে। যার জন্য একটা শান্তির্পূণ ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সুযোগ সন্ধ্যানীরা ঘোঁট পাকানোর সময় পায়। পরিণতিতে যা হওয়ার তাই হয়েছে, কোটা আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে যারা কোটা আন্দোলনের ওপর ভর করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চেয়েছে, অস্বাভাবিক করতে চেয়েছে তারা কিছুটা সফলও হয়েছে। কোটা আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা সহিংসতা-তা-বের সঙ্গে জড়িত নয়। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত নয়। কোটা আন্দোলনে অনেক শিক্ষার্থী মারা গেছেন। শুধু তাই নয়, কয়েকজন সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ, পথচারী, শিশু এবং পুলিশও প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি বলেন, কোটা আন্দোলনের সহিংসতায় সবচেয়ে বড় ক্ষয়ক্ষতি প্রাণহানি। এরপর রাষ্ট্রীয় স্থাপনা, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের ক্ষয়ক্ষতি। এ ক্ষয়ক্ষতি হয়তো ধীরে ধীরে পূরণ করা সম্ভব হবে। কিন্তু প্রাণনাশের ঘটনা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। তাদের তো কোনোভাবেই ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। মায়ের খালি বুক পূরণ করতে পারব না। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে, স্বাভাবিক অবস্থায় দেশটাকে ফিরিয়ে আনা। এ জন্য প্রথম কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঙ্গনে ফিরিয়ে আনা।

বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোটা যেহেতু একটা সমাধান হয়ে গেছে। যেসব শিক্ষার্থী মারা গেছে, তাদের তালিকা করা, সেসব পরিবারের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। কোন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা মারা গেছে বিশেষ তদন্ত করে, তার রিপোর্ট দেশবাসীর কাছে প্রকাশ করা। শিক্ষার্থীদের মৃত্যু কীভাবে ঘটল, কারা জড়িত সেটাও বলা এবং দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা। ক্যাম্পাসে যে সমস্যার সুষ্ঠুভাবে সমাধান করার জন্য সাময়িকভাবে হলেও সব ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ করা উচিত। হলগুলোতে যে অস্বাভাবিক কার্যক্রম হয়, সেটা বন্ধ করা উচিত। জাসদ সভাপতি বলেন, কোনো শিক্ষার্থীকে যেন মামলায় জড়িয়ে হয়রানি না করা হয়। যদি নামও থাকে তাহলে নাম প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। শিক্ষাঙ্গনে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, তার জন্য কোনো পক্ষই যেন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে না পারে সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ক্যাম্পাসে কোনোভাবেই পুলিশি ব্যবস্থা রাখা উচিত নয়। স্বাভাবিক জীবন যাপন ফিরিয়ে আনার জন্য যারা মারা গেছেন, তাদের পরিবারের দায়িত্ব সরকারকে নেওয়া উচিত। যারাই আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। যারাই সহিংসতায় জড়িত, দল দেখে, মুখ দেখে নয়, কোনো রকম বৈষম্য না করে যারা প্রকৃত জড়িত তাদের সাজার ব্যবস্থা করা। উল্লেখ্য, অতীতে এ ধরনের বিচার ভালো করে হয়নি। সুতরাং এ ধরনের সন্ত্রাসীদের কী ধরনের বিচার কী উপায়ে দ্রুত করা যায় সেটা ভেবে দেখা দরকার।

সাবেক তথ্যমন্ত্রী ইনু বলেন, আমি যখন সন্ত্রাসীদের বিচার দাবি করছি, তখন পুলিশ প্রশাসনের ভিতরে গাফিলতির জন্য কারা দায়ী, কেন পুলিশ অপ্রয়োজনীয় গুলিবর্ষণ করেছে, তাদের খুঁজে বের করা উচিত। পুলিশ প্রশাসনের জন্যই তাদের খুঁজে বের করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। পুলিশ প্রশাসনে সংস্কার করা জরুরি। সহিংসতা মোকাবিলায় পুলিশের কী কী গাফিলতি হয়েছে, দায় কার সেটা চিহ্নিত করা উচিত বলে মনে করি। তিনি বলেন, জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা উচিত। উদাহরণস্বরূপ রংপুরে যে ছেলেটা মারা গেছে, যে পুলিশকে গুলি করতে দেখা গেছে, তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য সাসপেন্ড করা উচিত ছিল। তদন্তে দেওয়া উচিত ছিল। এখনো সাসপেন্ড করা করা হয়নি। তাহলে মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আসত। অপ্রয়োজনীয় হত্যাকান্ড কেন ঘটল? এর জবাব তো দিতে হবে। কাউকে না কাউকে দিতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটা পূর্ণাঙ্গ তথ্যভিত্তিক শ্বেতপত্র আসা উচিত। তা না হলে গুজব চলতেই থাকবে। গুজবের ঝাপটায় বাংলাদেশ বিপর্যস্ত হবে। আমরা যারা স্বাভাবিক রাজনীতি করি, সামাজিক মানুষ, গুজবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হব। একটা শ্বেতপত্র গুজব থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে।

মহাজোট সরকারের সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, একটা সংঘর্ষ হয়েছে, এজন্য সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। যাকেই দায়ী করি না কেন, এটা সত্য যে সংঘর্ষ হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কোনো অজুহাত না খুঁজে সরকারকে ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার মাথায় নিয়ে পুষিয়ে নেওয়া উচিত। আমরা দেশটায় শান্তি ফেরত আনার চেষ্টা করছি। সব দোষ নন্দঘোষ, এ কথায় আমি একমত নই। আয়নায় নিজের চেহারা দেখা উচিত। তাহলে বুঝবেন, সব দোষ নন্দঘোষের নয়। সবকিছু বিবেচনা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।

সর্বশেষ খবর