মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

ঢাকায় নাশকতার ২৪৩ মামলা

গ্রেপ্তার ২৮২২, রিমান্ডে শিমুল মাহতাব নীরবসহ ৯ জন

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকায় নাশকতার ২৪৩ মামলা

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, সংঘাত, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের নাশতকার ঘটনায় রাজধানী ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মেস, আবাসিক হোটেল, হামলাকারীদের বাসাবাড়ি ও গোপন আস্তানা টার্গেট করে ব্লক রেইড দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদিকে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে আদালতপাড়া। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) কে এন রায় নিয়তি জানান, গতকাল পর্যন্ত ঢাকায় ২ হাজার ৮২২ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার করা হয় ৫৮ জনকে। গতকাল পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মোট ২৪৩টি মামলা হয়েছে। গতকাল নতুন মামলা হয়েছে ১৪টি। অন্যদিকে র‌্যাব জানিয়েছে, নাশকতার অভিযোগে একই দিনে তারা ৩৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। র‌্যাব সদর দপ্তর এএসপি (মিডিয়া) আ ন ম ইমরান খান জানান, সহিংসতার ঘটনায় গত রবিবার সারা দেশ থেকে ৩৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৮৩ জন এবং ঢাকার বাইরে ২৫১ জন। এর আগে সারা দেশ থেকে গত শনিবার ৩০৪ জনকে, শুক্রবার ২৯০ জনকে, বৃহস্পতিবার ২৬৬ জনকে এবং বুধবার ২২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা লাগাতার কর্মসূচি শুরু করেন ১ জুলাই। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় সারা দেশে। এর পরদিন থেকে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন জায়গায় এসব ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। এখনো বিভিন্ন জায়গায় মামলা হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এবং দল দুটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেশি ঘটেছে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে। রাজধানীর উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মিরপুর, আজিমপুর, নীলক্ষেতসহ প্রায় পুরো রাজধানীতে সংর্ঘষের ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনার পর মামলা ও গ্রেফতারও বেশি হচ্ছে রাজধানী ও এর চারপাশে। ২১ জুলাই রাত থেকে রাজধানীতে চিরুনি অভিযান শুরু করে পুলিশ ও র‌্যাব। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্রেফতার অভিযানে ‘ব্লক রেইড’ দেওয়া হচ্ছে। সহিংসতায় কারা জড়িত ছিলেন, তা বের করতে ভিডিও ফুটেজ ও ছবি বিশ্লেষণ করে তালিকাও করা হয়েছে।

থানা ও আদালতে ভিড় : গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা থানা ও আদালতের সামনে ভিড় করেন। কয়েকজন আসামির আইনজীবীরা দাবি করছেন, হয়রানির উদ্দেশ্যে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয়েছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আসামিদের গ্রেফতার করা হয়।

স্বজনদের আহাজারি আদালতপাড়ায় : আদালত প্রতিবেদক জানান, গত ১৮ জুলাই মগবাজার থেকে উত্তরার বাসায় ফেরার পথে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন নূর মোহাম্মদ। হামিম গ্রুপে চাকরি করতেন তিনি। গ্রেপ্তারের দুই দিন পরই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডানে যাওয়ার কথা ছিল তার। নাশকতার মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়ায় ফিকে হয়ে গেছে তার বিদেশ যাওয়ার রঙিন স্বপ্ন। অনিশ্চয়তার ছায়া নেমে এসেছে নূর মোহাম্মদের স্ত্রী স্মৃতি আক্তারের চেহারায়। ঢাকার নিম্ন আদালতের সামনে চোখের পানি মুছতে মুছতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব তথ্য জানান স্মৃতি আক্তার। তিনি বলেন, ১৮ জুলাই আমার স্বামীকে গ্রেফতার করার পর আমি উত্তরা-পূর্ব থানায় গেলে পুলিশ স্বামীকে ছাড়ানোর জন্য ৪০ হাজার টাকা দাবি করে। পরে টাকা দিতে চাইলেও ছাড়েনি। উল্টো আমার শাশুড়ির মাথা ও ঘাড়ে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরেছে পুলিশ। আজ (সোমবার) উকিল ধরে স্বামীকে জামিন করানোর জন্য আদালতে এসেছি। স্বামীকে গ্রেফতারের পর পুলিশ কর্তৃক তার পাসপোর্টও ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ করেন স্মৃতি আক্তার। স্মৃতি বলেন, আমার স্বামী কোনো রাজনীতি করে না। আমি তার মুক্তি চাই। স্মৃতি আক্তারের মতো এমন অনেকের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে আহাজারির আওয়াজ। প্রতিদিনই গ্রেফতার হওয়া আসামিদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পরিবেশ।

আদালত চত্বরে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় রিনা খাতুন নামক এক নারীর। তিনি জানান, তার স্বামী পুরান ঢাকার বাবুবাজার এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কার্ড তৈরির ব্যবসা করতেন। বাসায় ফেরার পথে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। গতকাল আদালতে তুলবে জানতে পেরে আদালত এলাকায় আসেন তিনি। কোলে ছিল পাঁচ বছরের শিশুকন্যা মুসকান। বাবাকে একপলক দেখার জন্য মুসকান যেন চাতকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আদালতের হাজতখানার দিকে। হাজতখানার সামনেই নিজ ভাগনেকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে দেখা যায় প্রৌঢ়া এক নারীকে। তিনি জানান, কামরাঙ্গীরচর থেকে তার স্বামী মো. সোহেলকে ধরে এনেছে পুলিশ। ওই নারীর সঙ্গে থাকা ছেলে বলেন, আমার খালুকে ধরে নিয়ে এসেছে। এখন মিডিয়ায় কথা বললে আরও সমস্যা হবে। আমরা খুব ভয়ে আছি। এমন ভয়ের ছাপ লক্ষ্য করা যায় অনেকের চোখেমুখে। সাংবাদিক দেখলে লুকোচুরিও করেন অনেকে। কেউবা আড়ালে চোখ মোছেন। কেউ দৌড়াতে থাকেন পুলিশ ভ্যানের পিছু পিছু।

চট্টগ্রামে আরও ২৩ জন গ্রেপ্তার : চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে নাশকতার অভিযোগে গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) বিভিন্ন থানায় অভিযান চালিয়ে আরও ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ নিয়ে সিএমপির ২০টি মামলায় গত ১৩ দিনে মোট ৫৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদিকে জেলা পুলিশ ২৪ ঘণ্টায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। জেলার ১১ মামলায় মোট ৩৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল এসব তথ্য জানানো হয়।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) কাজী তারেক আজিজ এবং চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আবু তৈয়ব মো. আরিফ হোসেন এসব তথ্য জানান।

ফেনীতে বিএনপি-জামায়াতের আরও সাত নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার : কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতা ও নাশকতার অভিযোগে পুলিশ রবিবার দিবাগত রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ নিয়ে জেলায় বিএনপি-জামায়াতের ৯৭ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলো। পুলিশের দায়ের করা দুটি মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদিকে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের ধরে পুলিশে সোপর্দ করছে। জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আলাল উদ্দিন আলাল গতকাল মুঠোফোনে এ অভিযোগ করেন।

 

নাটোরে জামায়াত-বিএনপির আরও আট নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার

নাটোরে গত ২৪ ঘণ্টায় বিএনপি-জামায়াতের আরও আট নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ইন্ধনের অভিযোগে নাটোর সিটি কলেজের অধ্যক্ষ মো. দেলোয়ার হোসেন খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি নাটোর জেলা জামায়াতের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বলে জানা গেছে। নাশকতা ও সংঘর্ষের অভিযোগে দায়ের করা আট মামলায় সোমবার পর্যন্ত শিক্ষার্থীসহ বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, জামায়াত ও শিবিরের ১০৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

 

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির গ্রেপ্তার

কোটা আন্দোলনে সহিংস ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির সমশের মোল্যাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রবিবার সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার উলপুর ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

শিমুল বিশ্বাস-মাহতাব নীরবসহ রিমান্ডে ৯ জন : কোটা সংস্কার আন্দোলনে নাশকতার একাধিক মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাব ও ঢাকা মহানগর (উত্তর) বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল আলম নীরবসহ নয়জনের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রাজধানীর রামপুরা ও বনানী থানার দুই মামলায় গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ও সাইফুল আলম নীরবসহ সাতজনের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

গতকাল মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইয়াসিন শিকদার আসামিদের আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. রশিদুল আলমের আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এদিন একই মামলায় রিমান্ড যাওয়া অপর আসামিরা হলেন- ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম মজনু, বিএনপি নেতা রশীদুজ্জামান মিল্লাত, ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা, মহিউদ্দিন হৃদয় ও তরিকুল ইসলাম।

এদিন আসামিদের পক্ষে তাদের আইনজীবী মহসিন মিয়া, সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেসবাহ, তাহেরুল ইসলাম তৌহিদ, হান্নান ভূঁঁইয়াসহ আরও অনেকেই রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু জামিনের বিরোধিতা করেন।

সেতু ভবনে হামলার মামলায় মাহতাব-আরিফ রিমান্ডে : কোটা আন্দোলনের সময় সেতু ভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বনানী থানার মামলায় ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে আলোচিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবের ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই মামলায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকেও ছয় দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন আদালত। গতকাল তাদের আদালতে হাজির করে ডিবি পুলিশ। এর পর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক আবু সাইদ মিয়া। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মইনুল ইসলামের আদালত ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এ ছাড়া এদিন ঢাকার মেট্রোপলিটন এলাকা থেকে নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার ১১৯ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে কোটা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে ডিএমপির ৫০টি থানার নাশকতার ২৬৪ মামলায় মোট ২ হাজার ৭৪৯ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর