বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

ব্লক ও টার্গেট রেইড

ঢাকায় ২৬৪ মামলায় গ্রেপ্তার ২৮৫০ জন, ৫৩ হত্যা মামলা, ফের রিমান্ডে পার্থ জাহাঙ্গীর, কারাগারে সাঈদসহ ১৪১

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্লক ও টার্গেট রেইড

রাজধানীতে গ্রেপ্তারকৃতদের গতকাল আদালতে তোলা হয়

কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, সংঘাত, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন এলাকার মেস, আবাসিক হোটেল, হামলাকারীদের বাসাবাড়ি ও গোপন আস্তানায় ব্লক ও টার্গেট রেইড দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত ঢাকায় ২৬৪ মামলায় ২ হাজার ৮৫০ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার করা হয় ২৮ জনকে। নতুন মামলা হয়েছে ২১টি। নিহতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ঢাকায় ৫৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে নিহতের পরিবার এবং কিছু মামলায় রাষ্ট্রের পক্ষে পুলিশ বাদী হয়েছে। র‌্যাব জানিয়েছে, নাশকতার অভিযোগে একই দিনে তারা ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ডিএমপির যুগ্মকমিশনার (অপারেশন্স) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, সহিংসতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ঢাকায় ২৬৪ মামলায় ২ হাজার ৮৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও চার-পাঁচটি মামলা প্রক্রিয়াধীন। রাজধানীতে কিছু এলাকায় ব্লক রেইড, কিছু এলাকায় টার্গেট অভিযান চলছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা লাগাতার কর্মসূচি শুরু করেন ১ জুলাই। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় সারা দেশে। এর পরদিন থেকে এ আন্দোলন কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন জায়গায় এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে। এখনো বিভিন্ন জায়গায় মামলা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এবং দল দুটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা বেশি ঘটেছে রাজধানী ঢাকা ও আশপাশে। রাজধানীর উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মিরপুর, আজিমপুর, নীলক্ষেতসহ প্রায় পুরো রাজধানীতে সংঘর্ষ ঘটেছিল। ঘটনার পর মামলা ও গ্রেপ্তারও বেশি হচ্ছে রাজধানী ও এর চারপাশে। ২১ জুলাই রাতে রাজধানীতে চিরুনি অভিযান শুরু করে পুলিশ ও র‌্যাব। সহিংসতায় কারা জড়িত ছিলেন, তা শনাক্ত করতে ভিডিও ফুটেজ ও ছবি বিশ্লেষণ করে তালিকাও করা হয়েছে।

আন্দোলনে সহিংসতা ঢাকায় ৫৩ হত্যা মামলা: কোটাবিরোধী আন্দোলনে সহিংসতায় ঢাকায় বিভিন্ন থানায় ৫৩টি হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি মামলার বাদী হয়েছেন নিহতদের পরিবার এবং কিছু মামলার বাদী হয়েছে রাষ্ট্রের পক্ষে পুলিশ। গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তরের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান যুগ্ম কমিশনার (অপারেশনস) বিপ্লব কুমার সরকার। অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রেপ্তারবাণিজ্য অনেক পুরোনো একটি শব্দ। ডিএমপি কমিশনার যেদিন থেকে ব্লক রেইডের নির্দেশ দিয়েছেন সেদিন থেকেই গ্রেপ্তারবাণিজ্য শব্দের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। যদি এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে দায়ী পুলিশ সদস্যকে শুধু প্রত্যাহার নয়, তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, নিরস্ত্র মানুষকে পুলিশ গুলি করছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে পুলিশ বিব্রত কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, প্রত্যেকটি ঘটনার পূর্বাপর বিচার করতে হবে। আমাদের সদস্য যদি গুলি করে থাকে কোন প্রেক্ষাপটে গুলি করেছে সেগুলো পর্যালোচনা করা হবে। যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে প্রত্যেকটি মামলার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করা হবে। যেন প্রশ্ন না ওঠে যে পুলিশ মামলা নিয়ে পক্ষপাত করছে। যখন একটি মামলা করা হয় তখন কে কোন দলের, কে কোন মতের, কে কোন পক্ষের বা বিপক্ষের এগুলো আমাদের কাছে কোনো বিচার্য বিষয় নয়। সাধারণ মানুষ যখন একটি এজাহার করেন তখন পুলিশের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। তাই এখানে কোনো দল-মত কিংবা পক্ষ-বিপক্ষের সুযোগ নেই। মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং যেই দোষী হবে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, গত কয়েক দিনে ঢাকা শহরে নাশকতামূলক কর্মকান্ড ও প্রাণহানির ঘটনায় ডিএমপির ৫০টি থানায় ২৬৪টি মামলা হয়েছে। আরও ৪-৫টি মামলা প্রক্রিয়াধীন। এসব মামলায় ২ হাজার ৮৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রিমান্ডে আনা হয়েছে অসংখ্য আসামিকে। রিমান্ডে থাকা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে যে তথ্য পেয়েছি সেসব তথ্য যাচাইবাছাই করে দেখছি। এসব মামলা শতভাগ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্ত করা হবে। পুলিশ এখানে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে তদন্ত করবে। সেই মামলাগুলো ডিএমপি কমিশনার নিজে তদন্ত তদারকি করবেন। সিনিয়র অফিসারদের এসব মামলা মনিটরিংয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ফের রিমান্ডে পার্থ-জাহাঙ্গীর, সাঈদসহ কারাগারে ১৪১ জন : কোটা আন্দোলন চলাকালে সেতু ভবন ও মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় করা দুই মামলায় সাবেক এমপি ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সভাপতি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ ও যুবদল নেতা এস এম জাহাঙ্গীরকে ফের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাদের এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ ছাড়া ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ খানসহ ১৪১ জনকে বিভিন্ন নাশকতার মামলায় কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত।

সেতু ভবনে হামলার মামলায় ফের তিন দিনের রিমান্ডে পার্থ : রাজধানীর বনানীর সেতু ভবনে হামলার ঘটনায় করা মামলায় বিজেপি সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থর ফের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। মঙ্গলবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুর রহমানের আদালত এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিন একই আদালত এ মামলার আরও দুই আসামি মীর নাজমুস সাকিব ও তাওহীদ ইবনুল বদর সাফওয়ানের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে ২৫ জুলাই পার্থকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এর পর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। অন্যদিকে তার আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান সোহাগ উদ্দিন তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে ২৪ জুলাই রাতে ডিবি পুলিশ রাজধানীর বারিধারা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। সেতু ভবনে হামলার ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির কেয়ারটেকার রবিউল ইসলাম বাদী হয়ে বনানী থানায় এ মামলাটি করেন।

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলায় জাহাঙ্গীরসহ দুজন আবারও রিমান্ডে : কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলুর ছেলে ওমর শরীফকে আবারও পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা শাকিলা সুমু চৌধুরীর আদালত এই আদেশ দেন। এর আগে উত্তরা পূর্ব থানার এক মামলায় রিমান্ড শেষে তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। এর পর মিরপুর মডেল থানার নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোসহ ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করে ডিবি পুলিশ। এ সময় আসামিপক্ষে আইনজীবী সৈয়দ নজরুল ইসলাম রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষ এর বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষে শুনানি শেষে আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করে প্রত্যেকের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গত ২৫ জুলাই নাশকতার অভিযোগে উত্তরা পূর্ব থানার মামলায় এই দুজনের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন আদালত।

জানা যায়, গত ২৩ জুলাই ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের এমআরটি লাইন-৬ এর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক মো. গোলাম রসূল আজাদ বাদী হয়ে মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় তিনি কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনের মিরপুর থানার আওতাধীন অংশে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে ৫০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। এ মামলার এজাহারে বলা হয়, আন্দোলনকারীদের হামলায় মেট্রোরেল স্টেশনের ১০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মিরপুর মডেল থানার অংশে ৫০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়।

সাঈদ খানসহ কারাগারে ১৪১ : কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনে ভাঙচুরের মামলায় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ খানকে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে উপস্থিত করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আক্তারুজ্জামান। এ ছাড়া গতকাল কোটা আন্দোলনে নাশকতার বিভিন্ন মামলায় আরও ১৪১ জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে ডিএমপি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো আসামিদের সংখ্যা দাঁড়াল ২ হাজার ৮৯১ জনে। এর মধ্যে অন্তত কয়েক শ আসামি বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড ভোগ করেন। এদিকে নাশকতার ঘটনায় মঙ্গলবার নতুন করে আরও পাঁচটি মামলা রুজুর খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা দাঁড়াল ২৭০টিতে।

সর্বশেষ খবর