বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

শ্রীলঙ্কার মতো সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা ছিল : প্রধানমন্ত্রী

ভাবতে পারিনি এত তাজা প্রাণ যাবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

শ্রীলঙ্কার মতো সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা ছিল : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গতকাল ভারতীয় হাইকমিশনারের সাক্ষাৎ -পিআইডি

কোটা সংস্কার আন্দোলন সাধারণ কোনো আন্দোলন ছিল না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ঘটিয়ে শ্রীলঙ্কার মতো সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা ছিল। গতকাল গণভবনে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে তাকে তিনি এ কথা বলেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি জানান, প্রণয় ভার্মাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এটা কোনো সাধারণ আন্দোলন ছিল না। এটা এক পর্যায়ে প্রায় সন্ত্রাসী আক্রমণের মতো হয়ে যায়। তারা (বিশৃঙ্খলাকারী) তো আসলে শ্রীলঙ্কার মতো সহিংসতা ও সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিল। তিনি সাম্প্রতিক সহিংসতায় জীবন ও সম্পদহানির কথা দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করেন।

এ সময় ভারতের হাই কমিশনার বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতায় জীবন ও সম্পদহানির ঘটনায় শোক জানান। ধারাবাহিকভাবে পরিস্থিতির স্বাভাবিক হওয়া ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসাকে স্বাগত জানান। প্রণয় ভার্মা বলেন, ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে ভারত সব সময় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের ভিশন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিকে সমর্থন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর প্রসঙ্গে প্রণয় ভার্মা বলেন, তার সাম্প্রতিক সফল সফর অর্থবহ ফলাফল অর্জন করেছে। যা অতীতের অর্জনকে সুসংহত করেছে এবং ভবিষ্যতে সহযোগিতার একটা ব্লু-প্রিন্ট সৃষ্টি করেছে। হাইকমিশনার আরও বলেন, দুই দেশের যে জাতীয় ডেভেলপমেন্ট ভিশন, বাংলাদেশের ২০৪১ এবং ভারতের ২০৪৭ ভিশনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সহযোগিতার একটা নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। ডিজিটাল ও গ্রিন অংশীদারি, স্যাটেলাইটের যৌথ উন্নয়ন, ব্লু-ইকোনমি, ওশানোগ্রাফি, ফিনটেকসহ নতুন নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতা হবে। আঞ্চলিক কানেকটিভিটি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চার দেশের (বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, নেপাল এবং ভুটান) মধ্যে কানেকটিভিটি জোরালো করার জন্য আমার সব দরজা খোলা। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।

ভাবতে পারিনি এত তাজা প্রাণ যাবে: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আন্দোলনের নামে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে, ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে, অনেকগুলো প্রাণ শেষ হয়ে গেছে... আমি কোনো দিন ভাবতে পারিনি, এই সময় এই ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হবে, আর সেখানে এতগুলো তাজা প্রাণ যাবে। গতকাল সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। পরে গণভবনের পুকুরে মাছের পোনা অবমুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কষ্টের বিষয় হলো, যেখানে কোনো ইস্যুই ছিল না.. যে কোটা আমি সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দিয়েছিলাম... হাই কোর্টের রায়ে এটাকে যখন আবার নিয়ে আসা হয়, তখন আমরা সরকারের পক্ষ থেকে আপিল করি। আপিল বিভাগ হাই কোর্টের রায় স্থগিত করে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ শুনানির তারিখ নির্দিষ্ট করে দেয়। কাজেই আবার সেই কোটা ফিরে আসে।

শেখ হাসিনা বলেন, কোটা সংস্কার ইস্যুতে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপিল করে সরকার। সব দাবি মানা হলো। তার পরও এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে যা যা ঘটেছে, এত প্রাণ যাবে, এটা ভাবতেও পারিনি আমি। আমার দিক থেকে কোটা ইস্যুতে কোনো ঘাটতি রাখিনি। যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। স্থাপনা হয়তো পুনর্নির্মাণ করা যাবে, ফিরে পাওয়া যাবে, কিন্তু যে প্রাণগুলো ঝরে গেল, তারা তো আর ফিরবে না।সরকারপ্রধান বলেন, আমি জানি না অপরাধটা কী আমাদের। যে ইস্যুটা নেই সেটা নিয়ে আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে কে কী অর্জন করল সেটাই আমার প্রশ্ন। সেখানে এতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেল। সেগুলো তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। শেখ হাসিনা বলেন, স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে আমি বেঁচে আছি। আমি জানি আপনজন হারালে কী কষ্ট হয়। মানুষ একটা শোক সইতে পারে না আর আমি তো সবাইকে হারিয়ে আছি।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে প্রাণহানি ও সহিংসতার সুষ্ঠু তদন্তে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এ বিষয়ে ইতোমধ্যে আমরা জুডিশিয়াল কমিটি গঠন করে দিয়েছি। কারও দাবির অপেক্ষায় আমি থাকিনি। আগেই জুডিশিয়াল কমিটি করে দেওয়া হয়, আজকে আবার আমরা নির্দেশ দিয়েছি... আমরা একজন জজ সাহেবকে (বিচারপতি) দিয়ে (তদন্ত কমিটি) করেছিলাম। আমি বলেছি (কমিটিতে) আরও দুজন জজ সাহেবকে দিয়ে (অন্তর্ভুক্ত করে), আরও দুজন লোকবল বৃদ্ধি করে দিয়ে এবং তাদের (কমিটির) তদন্তের পরিধি বাড়ানো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জাতিসংঘের কাছেও আবেদন করেছি। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সংস্থা আছে, বিশেষ করে বিদেশে; তাদের কাছেও আমরা সহযোগিতা চাই। যেন এ ঘটনার যথাযথ সুষ্ঠু তদন্ত এবং যারা এর সঙ্গে দোষী তাদের সাজার ব্যবস্থা (করা যায়)। কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে নিজের কোনো ঘাটতি ছিল না জানিয়ে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, আমি জানি, এখানে আমার কোনো ঘাটতি ছিল না। যারা (আন্দোলনকারী) বসেছিল (আলোচনায়), আমি তাদের দাবি মেনে নিয়েছি। আর তাদের দাবি মানব কী, যেটা আমি করে দিয়েছি (কোটা বাতিল) সেটাই তো, এটা তো আমারই করা (কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন), ইস্যুটা তো আমারই। আপিল করা হয়েছে অ্যাপিলেট ডিভিশনে। তার পরও এই যে একটা ঘটনা ঘটিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে দেশকে পেছনে টেনে নেওয়ার এই চক্রান্তে যারা জড়িত, সেটা আপনাদের খুঁজে বের করা উচিত। তিনি আরও বলেন, ওই একাত্তরে যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর ছিল, তাদের চক্রান্ত বারবার আমাদের দেশকে পিছিয়ে নিয়ে গেছে। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে কষ্টের, সবচেয়ে দুঃখের। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই আন্দোলনের নামে যেসব ঘটনা ঘটেছে, ধ্বংসাত্মক কাজ করা হয়েছে; তাতে অনেক তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। তিনি বলেন, জানি না, অপরাধটা কী ছিল আমার? যে ইস্যুটা নেই, সেটা নিয়ে আন্দোলনের নামে এই ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করে দেশের অর্জনকে নষ্ট করা, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করাতে কে কী অর্জন করল, সেটাই আমার প্রশ্ন?

সরকারপ্রধান বলেন, আমার কাছে ক্ষমতা কোনো ভোগের বস্তু নয়, আমি তো আরাম-আয়েশ করার জন্য ক্ষমতায় আসিনি। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি দেশকে একটু উন্নত করতে। যেটা সফলভাবে করতেও পেরেছি। আজ বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। সেই মর্যাদাকে কেন নষ্ট করা হলো? সে প্রশ্ন উত্থাপন করে এর বিচারের ভার তিনি দেশবাসীর কাছে দিয়ে দেন।

১৯৮১ সালে বাংলাদেশে আসার পর থেকে গুলি, বোমা পুঁতে রেখে, গ্রেনেড হামলা করে প্রধানমন্ত্রীর ওপর বহুবার হত্যা প্রচেষ্টার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, আমি তো জীবনের পরোয়া করিনি। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার পাশাপাশি ভূমিহীন-গৃহহীনকে বিনামূল্যে ঘর করে দেওয়া, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে মানুষের জীবনযাপন আরও সহজ করে দেওয়াই আমার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু যেসব জিনিস মানুষকে সেবা দেয়, সেগুলোই হামলাকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো। আবেগতাড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমি যেহেতু স্বজন হারিয়েছি। স্বজন হারানোর বেদনা আমি বুঝি। তাই যারা আপনজন হারিয়েছেন তাদের প্রতি আমার সহমর্মিতা জানাচ্ছি। তিনি বলেন, তারা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করেছে। স্থাপনা যে ধ্বংস করেছে সেগুলো তো পুনর্গঠন করা যাবে। কিন্তু যে প্রাণগুলো ঝরে গেল, সেগুলো তো আমরা আর ফিরে পাব না।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. আবদুর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সাত ক্যাটাগরিতে ২২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাঝে ‘জাতীয় মৎস্যপদক-২০২৪’ প্রদান করেন। মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ আলমগীর পুরস্কার প্রদান পর্বটি সঞ্চালনা করেন। পুরস্কার হিসেবে ছয়টি স্বর্ণ, আটটি রৌপ্য ও আটটি ব্রোঞ্জ পদক, সম্মাননা স্মারক এবং পুরস্কারের অর্থ প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে জেলেদের মধ্যে স্মার্ট আইডি কার্ডও বিতরণ করেন। ২২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মাছ চাষে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীকেও অনুষ্ঠানে স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। দেশের মৎস্য খাতের উন্নয়নের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হয়।

সর্বশেষ খবর