শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

দেশ ও আন্তর্জাতিক তদন্তে হাসিনা

♦ গণহত্যার অভিযোগ তদন্ত শুরু ♦ মানবতাবিরোধী অপরাধের নতুন অভিযোগ আসছে জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত দল ♦ ঢাকায় আরও দুই মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশ ও আন্তর্জাতিক তদন্তে হাসিনা

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের ডাক। গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় দেশি ও আন্তর্জাতিক তদন্তের মুখে পড়তে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সদ্যপদত্যাগ করে দেশছাড়া শেখ হাসিনা।

ঘটনার তদন্তে আগামী সপ্তাহেই দেশে আসছে জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশন। আর এরই মধ্যে ওই সময়ের মৃত্যুর ঘটনাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ উল্লেখ করে দাখিল করা অভিযোগের তদন্ত শুরু করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

গতকাল এ সংস্থায় দাখিল হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের নতুন অভিযোগ। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গতকালও দুটি মামলা হয়েছে। এ নিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হওয়া মামলার সংখ্যা দাঁড়াল ৫-এ। চারটি হত্যা ও একটি গুমের। জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশন ঢাকায় আসার বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস। গতকাল দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার সঙ্গে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। পরে পৃথক ব্রিফিংয়ে আলোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন গোয়েন লুইস ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, জাতিসংঘকে এ তদন্ত কাজে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে অন্তর্বর্তী সরকার। গোয়েন লুইস বলেন, তদন্তের জন্য আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশে আসবে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন। এ মিশন স্বাধীনভাবে কাজ করবে। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের তদন্তের অর্থায়ন করবে জাতিসংঘ। এ নিয়ে কর্মপ্রক্রিয়া ও পরিধি ঠিক করতে কাজ করছে জাতিসংঘ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের আগের দিনের ফোনালাপের বরাত দিয়ে গোয়েন লুইস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারও তদন্ত দলকে সহায়তা করবে।

গণহত্যার অভিযোগের তদন্ত শুরু : ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ উল্লেখ করে শেখ হাসিনাসহ নয়জন ব্যক্তি এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা বুধবার রাতেই এ অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন অভিযোগকারী আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম। আইনজীবী তামিম বলেন, শেখ হাসিনাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতনের অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা রেকর্ড করে আতাউর রহমানকে এ অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন। গতকাল বুধবার রাত থেকেই শেখ হাসিনাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতনের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে দিয়েছেন তিনি। এর আগে বুধবার তদন্ত সংস্থায় এ অভিযোগ জমা দেন তামিম। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত বাগেরহাটের আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা মো. বুলবুল কবিরের পক্ষে এ আবেদন করেন তিনি।

মানবতাবিরোধী অপরাধের নতুন অভিযোগ : ২০ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনদি এলাকায় গজারিয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মো. মেহেদী হাসানের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় নতুন আরেকটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। নিহত মেহেদীর বাবা মো. সানাউল্লাহ বাদী হয়ে গতকাল এ অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ নয় আসামির নাম উল্লেখ করে র‌্যাব ও পুলিশের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে। গতকাল আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম এ অভিযোগের বিষয়টিও নিশ্চিত করেন।

শেখ হাসিনার সঙ্গে অন্য যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে তাঁরা হলেন- সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। এ ছাড়া আছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক উপপুলিশ মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান হারুন অর রশীদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ। একই অপরাধে ব্যক্তির পাশাপাশি দল এবং সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার আরজি জানানো হয়েছে আবেদনে।

ঢাকায় আরও দুই হত্যা মামলা : রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মাদরাসাছাত্র জোবাইদ হোসেন ইমনকে (১২) র‌্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা এবং শেরেবাংলানগরে অটোরিকশাচালক সাহাবুদ্দিন পুলিশের গুলিতে খুন হওয়ার ঘটনায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে আরও দুটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে দুজনের পরিবার বাদী হয়ে এ মামলা দুটি করে। আদালত দুটি মামলাই এজাহার হিসেবে গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশ দেন। ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের দারুন্নাজাত ইসলামিয়া মাদরাসার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র জোবাইদ হোসেন ইমনকে (১২) র‌্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ খুনের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৬ জনের নামে মামলা করেছেন নিহত ইমনের মামা আবদুল্লাহ আবু সাঈদ ভূঁইয়া। ঢাকার মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরীর আদালতে এ মামলা করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে মোহাম্মদপুর থানাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। ইমন হত্যা মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত আইজিপি ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ মহিদ উদ্দিন, ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার এবং হেলিকপ্টার টহল টিমের অজ্ঞাতনামা সদস্যরা। অন্যদিকে ৫ আগস্ট ঢাকার শেরেবাংলানগরে অটোরিকশা চালক সাহাবুদ্দিনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে। ঢাকার মহানগর হাকিম ফারাহ দিবা ছন্দার আদালতে এ মামলার আবেদন করেন নিহতের পিতা আবুল কালাম। আদালত মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার জন্য শেরেবাংলানগর থানাকে নির্দেশ দেন। এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। এ ছাড়া মামলায় অজ্ঞাতনামা পুলিশ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর