বিগত সরকারে থাকা যেসব ব্যক্তি যুক্তরাজ্যে অর্থ পাচার করে বাড়িঘরসহ নানা সম্পদ গড়েছেন, সেই অর্থ ফেরত আনতে দেশটির সহায়তা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক ও জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি। এ সময় তাদের কাছে এ সহায়তা চাওয়া হয়। বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমি সুগন্ধায় ব্রিফ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম। ব্রিটেনের হাইকমিশনার সারাহ কুক পাচার করা অর্থ ফেরতে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে বলেন, তার সরকার যতটা সম্ভব এ বিষয়ে বাংলাদেশের সরকারকে সাহায্য করবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে একটি অবাধ ও অংশীদারিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে কৌশলগত সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দেন সারাহ কুক। অন্যদিকে জাপানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে দেশ পুনর্গঠনে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা চাওয়া হয়েছে দেশটির কাছে। হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেন তার মধ্যে রয়েছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, পাচারকৃত অর্থ ফেরত, দেশ পুনর্গঠনে আর্থিক সহায়তা, গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে একটি কমিশন গঠন, এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর এবং রোহিঙ্গা ইস্যু ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকি বিবেচনা করে খুব শিগগিরই একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগের কথা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ ছাড়া গুম ও নিঁেখাজ ব্যক্তিদের ফেরত পাওয়াসহ এ ধরনের অপরাধের আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত করে অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে একটি কমিশন গঠন করা হবে বলেও হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূতকে অবহিত করা হয় বৈঠকে। প্রেস সচিব জানান, যুক্তরাজ্য এবং জাপান দুই দেশের হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূত নিজ নিজ দেশের সরকারের অভিনন্দন বার্তা প্রধান উপদেষ্টার কাছে পৌঁছে দেন। বৈঠকে পাচারকৃত অর্থ ট্র্যাক করে যুক্তরাজ্য যেন সে অর্থ বাংলাদেশে ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, সে বিষয়ে হাইকমিশনার সারাহ কুকের মাধ্যমে দেশটির সরকারের সহায়তা চান প্রধান উপদেষ্টা। প্রেস সচিব বলেন, প্রচুর মানুষ যে মানি লন্ডারিং করেছে, সেটাকে ট্র্যাক করা বা সেটাকে ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রেস সচিব বলেন, ব্রিটেনে অনেক বাংলাদেশি, বিগত সরকারের অনেকে সেখানে বাড়িঘর করেছে। টাকাটা কীভাবে গেল, এটা একটা বড় প্রশ্ন। যে টাকাটা পাচার হয়েছে, সে টাকাটা কীভাবে ফেরত আনা যায়- সে বিষয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের কাছে তিনি সহায়তা চান।
সাংবাদিকরা জানতে চান সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরাও ব্রিটেনের নাগরিক। দেশটিতে তাদের সম্পদের বিষয়ে কোনো তথ্য চাওয়া হয়েছে কি না। জবাবে প্রেস সচিব জানান, সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়নি। এখান থেকে যে টাকাটা চলে গেছে, সেটা ব্রিটেনে হতে পারে, অন্য কোথাও। অফশোর বিনিয়োগের অনেক জায়গা আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। যে টাকাটাই যাক না কেন, এটা তো চুরি করা টাকা। এটা ফেরত আনার বিষয়ে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ব্রিটিশ বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য হাইকমিশনারের মাধ্যমে সে দেশের বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। প্রেস সচিব বলেন, বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হচ্ছে যুক্তরাজ্য। প্রধান উপদেষ্টা আশা করছেন, ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে উদ্দেশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি, সেখানে ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই। প্রেস সচিব বলেন, শেখ হাসিনার (সরকারের) সময় অনেক মানুষ নিখোঁজ ও গুম হয়েছেন। মানবাধিকর বিষয়ক সংগঠন ‘অধিকার’র হিসাবে নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা ৭০০-এর বেশি। তার মধ্যে এখনো দেড় শর বেশি মানুষের কোনো হিসাব নেই। মায়ের ডাক নামে একটি সংগঠনের সদস্যরা তাদের স্বজনদের ফেরত পেতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখাও করেছেন। উপদেষ্টা পরিষদে এটা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে খুব দ্রুত এ সংক্রান্ত যে আন্তর্জাতিক কনভেনশন রয়েছে, তাতে অনুস্বাক্ষর করবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া একটি কমিশন গঠনের বিষয়েও আলোচনা চলছে। শ্রীলঙ্কায় একটি কমিশন আছে। সেই আদলে করা যায় কি না সে বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রেস সচিব জানান, আগের সরকার এটা অনুস্বাক্ষর করেনি, বর্তমান সরকার এটা করবে। আগামী ৩০ আগস্ট ‘দ্য ভিকটিম অব এনফোর্সড ডিস্যাপিয়ারেন্স’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক দিবস রয়েছে। এর আগেই সরকার এ সংক্রান্ত কনভেনশনে স্বাক্ষর করবে বলে জানান প্রেস সচিব।
সারাহ কুক বলেন, বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। এর বড় কারণ হচ্ছে দেশটিতে প্রায় ৭ লাখ ব্রিটিশ বাংলাদেশি রয়েছে-যারা দেশটির মূলধারার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।জাপানের রাষ্ট্রদূত বর্তমান বাংলাদেশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জাপানের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেছেন, হিরোশিমা, নাগাসাকিতে বোমা হামলার পর জাপানকে যে পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে, বাংলাদেশকে অনুরূপ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাপান তার সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলেও আশ্বাস দেন দেশটির রাষ্ট্রদূত। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অর্থনৈতিক সহায়তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং দুই দেশের মানুষে মানুষে সম্পর্ক- এই তিনটি ভিত্তির ওপর স্থাপিত বলে উল্লেখ করেন।
প্রফেসর ইউনূস রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে জাপান সরকারকে তার ধন্যবাদ পৌঁছে দেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের সরকারের নেতৃত্বে তিনি আছেন। এই রাষ্ট্রের পুনর্গঠনে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। বাংলাদেশ পুনর্গঠনে জাপান বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জাপানি রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি বাংলাদেশকে একটি বড় পরিবারের মতো দেখেন, যেখানে কেউ কারও শত্রু নয়। বাংলাদেশের সব মানুষ একই পরিবারের সদস্য বলেও উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রেস সচিব জানান, দুই রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের সঙ্গেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, চট্টগ্রামের বাসিন্দা হিসেবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভাষা তিনি ভালো বোঝেন। তিনি রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন। পাশাপাশি তাদের শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন, যেন রোহিঙ্গা জাতি হিসেবে বোঝা না হয়ে, মানবসম্পদ হিসেবে নিজেদের ভূখন্ডে ফিরতে পারেন। রোহিঙ্গাদের জীবন মানোন্নয়নে তিনি যুক্তরাজ্য ও জাপানের আর্থিক সহায়তা অব্যাহত থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেন। জাপানের রাষ্ট্রদূত তার দেশের একজন নামকরা স্থপতি তাদায়ান্দোর নাম উল্লেখ করে জানান, সেই স্থপতি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি লাইব্রেরির ডিজাইন করার প্রস্তাব দিয়েছেন।