বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা
রিমান্ডে সেই প্রভাবশালীরা

হুকুম পালনে বাধ্য ছিলাম

জল্লাদের ভূমিকায় ছিলেন তারিক সিদ্দিক

নিজস্ব প্রতিবেদক

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপরই দোষ চাপাচ্ছেন গ্রেপ্তারকৃতরা। বলছেন হাসিনাই তাদের ব্যবহার করেছেন। বৈধ-অবৈধ সবকিছুই করিয়েছেন তাদের দিয়ে। হাসিনার কাছে তাদের মতামতের কোনো মূল্য ছিল না। তারা হুকুম পালনে বাধ্য ছিলেন। তার সিদ্ধান্তের বাইরে গেলেই নেমে আসত নির্যাতনের খড়গ। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তারকৃতরা এসব কথা বলছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টদের। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আট দিনের রিমান্ডে থাকা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান দাবি করেছেন, তার বিরুদ্ধে আনা গুম-খুনের অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। শেখ হাসিনার আদেশ পালন করতে গিয়েই তার শত্রু তৈরি হয়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থায়। তারাই এখন সব সুযোগ নিচ্ছে।

জিয়াউলের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে সূত্র আরও বলছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক সব নাটের গুরু। বিভিন্ন সংস্থাকে তিনি ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। বাহিনীগুলোতে তার কথাই ছিল আইন। তার কথার বাইরে গেলেই ভয়ংকর পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে পেশাদার কর্মকর্তাদের।  গ্রেপ্তারকৃতদের বরাত দিয়ে সূত্র আরও বলছে, ২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকান্ডের পরই বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থায় দানবীয় রূপে হাজির হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। জল্লাদের ভূমিকায় ছিলেন তারিক সিদ্দিক। তবে বিডিআর হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে অনঢ় থাকা কর্মকর্তাদের অনেককে কোর্ট মার্শালে নিয়ে প্রহসনের বিচার করেছেন। অনেক দক্ষ এবং সাহসী কর্মকর্তাকে কোনো ধরনের কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বাড়ি পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করে গুম, খুন, দখল বাণিজ্য করাতেন তিনি। এর সুযোগ নিয়েছেন অনেক অতি উৎসাহী কর্মকর্তা। গ্রেপ্তারকৃতরা বলেছেন, পার্শ্ববর্তী একটি দেশের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সবকিছু নির্দেশ দিতেন হাসিনা। আর এর বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন তার ঘনিষ্ঠজন তারিক সিদ্দিক। এতে করে গত ১৫ বছরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার চরিত্রই বদলে গেছে। ডিবি সূত্র বলছে, তদন্ত তদারক কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই কান্নাকাটি শুরু করেন সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তার দাবি, তিনি সব কিছুই করেছেন শেখ হাসিনা পুত্র এবং উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে। জয় তার কমিশনের অর্থও নিয়েছেন বিভিন্ন দেশে তার পরিচিতজনদের অ্যাকাউন্টে। মাঝে মাঝে নিয়েছেন ক্যাশ ডলার। এর বৈধতা নিয়েছেন তার বিভিন্ন ব্যবসায়িক লাইসেন্স দিয়ে এবং কনসালটেন্সির কথা বলে। জিয়া এবং পলকের মতো অনেকটা একই বুলি আওড়াচ্ছেন গ্রেপ্তার সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

সাবেক এমপি আহমেদ ও রিয়ার অ্যাডমিরাল সোহাইল রিমান্ডে : নেত্রকোনা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন এবং নৌবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. সোহাইলের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকার পল্টনে গুলিবিদ্ধ গত ১৯ জুলাই মুদি দোকানি নবীন তালুকদার মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনায় তার স্ত্রী রুমা আক্তার ঢাকার পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় গতকাল আদালতে আসামিদের উপস্থিত করে পুলিশ। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে উভয়কে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিমের আদালত উভয়ের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড আবেদনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আসামিরা মামলার ঘটনার পরিকল্পনাকারী ও মাস্টার মাইন্ড। সারা দেশের কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় অবস্থান করলে আসামিদের নির্দেশে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন দমানোর জন্য অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে এলোপাতাড়িভাবে গুলি করলে বাদীর স্বামী ভিকটিম নবীন তালুকদার গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ১ নম্বর আসামি সাবেক সংসদ সদস্য আন্দোলন দমানোর জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। ২ নম্বর আসামি সরকারের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা হয়ে তিনিসহ অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে এনটিএমসি ও বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আন্দোলন দমনে ফোর্স প্রয়োগ করেছেন মর্মে ব্যাপক সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

আবদুর রহমান বদি কারাগারে : কক্সবাজারের টেকনাফে হত্যাচেষ্টা মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিকে চট্টগ্রামের জিইসি মোড় এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে সোপর্দ করে র‌্যাব। গতকাল কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হামিমুন তামজিদের আদালতে হাজির করা হয় তাকে। এ সময় বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর আগে, সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশের পাহারায় বদিকে আদালতে আনা হয়। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে কিছু লোকজন তাকে উদ্দেশ করে বিভিন্ন কটূক্তিমূলক স্লোগান দেয়। আদালতের নির্দেশ শেষে প্রিজনভ্যানে তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও টেকনাফ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুুল্লাহ আল মামুন বলেন, বিএনপি নেতা মোহাম্মদ আবদুুল্লাহকে হত্যাচেষ্টা মামলায় আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। অধিকতর তদন্তের স্বার্থে পুলিশ তার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করবে। পরবর্তীতে এ রিমান্ড শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। গত ১৮ আগস্ট টেকনাফ পৌরসভার কেকে পাড়া এলাকায় উপজেলা বিএনপির শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ আবদুল্লাহকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তুলে আবদুর রহমান বদি ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদসহ ২০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন আবদুল্লাহ।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম রিমান্ডে : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে ছাত্রদল নেতা রফিকুল ইসলাম নয়ন হত্যা মামলায় সাবেক এমপি ও সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাদেকুর রহমানের আদালতে তাকে হাজির করে ডিবি। এ সময় বাদী পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে নয় দিন মঞ্জুর করেন। এর আগে, ক্যাপ্টেন (অব.) তাজুল ইসলামকে রাজধানীর গুলশানের নিজ বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৬ নভেম্বর বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় মহাসমাবেশ সফল করতে ১৯ নভেম্বর বিকালে বাঞ্ছারামপুর থানা এলাকায় লিফলেট বিতরণ করছিলেন বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। এ সময় পুলিশ হামলা করলে সোনারামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নয়ন গুলিবিদ্ধ হন। নয়নকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় নেওয়ার পথে রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সে মারা যান। প্রসঙ্গত, গত ১৫ আগস্ট সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এর আগে, গত ১৪ আগস্ট রাজধানীর খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় এ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের রাজধানীর পল্টনে এক রিকশাচালককে হত্যার অভিযোগে পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ১৫ আগস্ট রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে রাজধানীর ঢাকা কলেজের সামনে এক হকারকে হত্যার অভিযোগে নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওইদিনই তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গত ১৩ আগস্ট রাজধানী ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের রাজধানীর ঢাকা কলেজের সামনে এক হকারকে হত্যার অভিযোগে নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলায় হত্যার ইন্ধনদাতা হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ১৪ আগস্ট তাদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এদিকে, গত ১৭ আগস্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামালকে রাজধানীর মহাখালী থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর