শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

বড় দুর্নীতির অনুসন্ধানে দুদক

সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ, অনুসন্ধান শুরু পলক বিপুসহ অনেকের সম্পদের

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, শেয়ারবাজারে জালিয়াতি, প্লেসমেন্ট শেয়ার কারসাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ার হোল্ডারদের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন। অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা। এদিকে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এবং নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। গতকাল সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় থেকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম। দুদক সূত্রে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নামে গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি ও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি করে দেশে টাকা না আনার অভিযোগও রয়েছে তার মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে। ২০০৬-০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও ঋণখেলাপিসহ নানা অভিযোগে জেলে গিয়েছিলেন সালমান এফ রহমান। এরপর জেল থেকে বের হয়ে নাম জড়ান ২০১০-১১ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে। গত ১৫ বছরে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে তার প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একটি ব্যাংক থেকেই নেওয়া হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। আর গত তিন বছরে তিনি দৃশ্যমানভাবেই বাজার থেকে নিয়েছেন ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সালমান এফ রহমান। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবসায়ী নেতার পর ২০১৮ সালে এমপি ও টানা দুবার প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন তিনি। ২০১০-১১ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। সেই রিপোর্টে পুঁজিবাজারে ফিক্সড প্রাইস, বুক-বিল্ডিং, রাইট শেয়ার, ডিরেক্ট লিস্টিং, সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, প্রেফারেন্স শেয়ারসহ সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম হওয়ার এবং এর সঙ্গে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। এ ছাড়া সালমান এফ রহমান বিভিন্ন কোম্পানির প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও প্রমাণ পায় সেই কমিটি। অথচ এসব অনিয়মের সঙ্গে সালমান এফ রহমানসহ আরও কয়েকজনের নাম জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুদক জানায়, সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন দশম জাতীয় সংসদে হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মৌলভীবাজার-১ আসন থেকে সপ্তম, নবম, দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পাঁচ বছরমেয়াদি ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকার ‘সুফল প্রকল্পটি’ শাহাব উদ্দিন ও তার ছেলে ১০ শতাংশ কমিশন নিয়ে ঠিকাদারদের কাজ দেন এবং বিভিন্ন খাতে ভুয়া খরচ দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। ৮০-৯০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে বন কর্মকর্তাদের বদলি ও পোস্টিং করেন। এ ছাড়া পরিবেশ দূষণে মারাত্মক প্রভাব রয়েছে এরূপ তরল বর্জ্য সৃষ্টিকারী বিভিন্ন কল-কারখানায় ইটিপি পরিদর্শন না করেই সার্টিফিকেট প্রদান করেন। প্রায় ৭ কোটি টাকার বিনিময়ে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের জমির রেজ্যুলেশনে স্বাক্ষর করে বিএফডিআইসির তৎকালীন চেয়ারম্যানকে ওই জমি জলবায়ু ট্রাস্টকে দিতে বাধ্য করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ভোলা-৩ আসনের সাবেক এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে লালমোহন ও তজুমদ্দিন উপজেলার টিআর ২ কোটি ২৯ লাখ ৮৪ হাজার ৭৯৭.৬২ টাকা, কাবিখা ও কাবিটা ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার ৫৪৬.৮০ টাকা এবং ২৬০ দশমিক ৩৯ মেট্রিক টন গম এবং ২৩৪ দশমিক ৩৩ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করে বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাটোর-৩ (সিংড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত) সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। সেই নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে নির্বাচনি ব্যয় বহন করেন তিনি। নির্বাচনি হলফনামায় লেখেন ১৫ শতক কৃষিজমি, ব্যাংকে ৫০ হাজার টাকা এবং ৬০ হাজার টাকার আসবাবপত্র রয়েছে তার। অভিযোগ আছে, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী হয়ে আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান পলক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা। তাই জয়ের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পান পলক। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে হয়ে ওঠেন স্বেচ্ছাচারী। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি হত্যা মামলায় গত ১৪ আগস্ট গ্রেপ্তার হন পলক। অন্যদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে আত্মগোপনে আছেন সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। এরই মধ্যে রাজধানীর বনানীতে নসরুল হামিদের মালিকানাধীন ‘প্রিয় প্রাঙ্গণ’ ভবনে মঙ্গলবার রাতভর অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় ‘প্রিয় প্রাঙ্গণ’ নামে ওই ভবনে নসরুলের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কার্যালয় থেকে বেশ কয়েকটি ভল্টে থাকা নগদ ১ কোটি ৫১ হাজার ৩০০ টাকা জব্দ করা হয়। এ অর্থের মধ্যে ৫১০ লিরাসহ (তুরস্কের মুদ্রা) কিছু বিদেশি মুদ্রা রয়েছে। অভিযানে অস্ত্র-গুলিসহ অন্য সামগ্রী জব্দ করা হয়েছে।

 

সর্বশেষ খবর