শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

ফেনী যেন বিচ্ছিন্ন এক জনপদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা ফেনী। জেলার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ। পানির নিচে পুরো জনপদ। একতলা ভবন তলিয়ে পানি উঠে গেছে দুই তলা পর্যন্ত। নেই বিদ্যুৎ। অচল হয়ে পড়েছে জেলার ৯২ ভাগ মোবাইল টাওয়ার। সারা বিশ্ব থেকে একপ্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে জেলাটি। পরিবার-পরিজন কোথায় আছেন, কেমন আছেন, সেই খবরটুকুও নিতে পারছেন না অনেকে। অন্যদিকে বিপদে পড়েও উদ্ধারকারীদের ডাকতে পারছেন না বিপদগ্রস্তরা। প্রবল স্রোতে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার কার্যক্রম। ফেনীতে অনেক মসজিদের মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে- সবাই সবাইকে মাফ করে দিয়েন। সব মিলে জেলাটিতে চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার ও পুনর্বাসন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

ফেনীর বাসিন্দারা বলছেন, গত ৫০-৬০ বছরেও জেলায় এমন ভয়াবহ বন্যা হয়নি। ১৯৮৮ সালের বন্যায়ও পুরো জেলা এভাবে প্লাবিত হয়নি। গত বৃহস্পতিবার থেকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে ফেনীর বাসিন্দারা। একই সঙ্গে মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই। পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়ায় কোনো যান চলাচল করতে পারছে না। বিভিন্ন বাসাবাড়ির ছাদে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে নিরাপদে সরিয়ে নিচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী। তবে আটকেপড়া মানুষের চেয়ে উদ্ধারকারীর সংখ্যা কম। এদিকে চার দিন পানিবন্দি থাকার পর ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার নিজকনজুরা এলাকার ষাটোর্ধ্ব নারী বিবি মরিয়মকে স্বেচ্ছাসেবীরা উদ্ধার করে একটি আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বসে কাঁদছিলেন এই নারী। কারণ, স্বামীসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের কোনো খবর জানেন না মরিয়ম।

বন্যার মধ্যে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উদ্বেগ বহুগুণ বেড়ে গেছে। দেশে রেখে যাওয়া পরিবার-পরিজনের খোঁজ চেয়ে গত তিন দিন ধরে অনবরত ফেসবুকে পোস্ট করছেন প্রবাসীরা। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে থাকা স্বজনরাও পরিবার-পরিজনের খোঁজ না পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন ফেসবুকে। তবে সেসব পোস্টে সহমর্মিতা মিললেও পাওয়া যাচ্ছে না স্বজনের খোঁজ। ফেনীতে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনের মোবাইলে বা মেসেঞ্জারে মেসেজ দিয়েও উত্তর মিলছে না। সড়ক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এলাকায় যেতেও পারছেন না অনেকে। ক্লোজআপ ওয়ান তারকা সাজিয়া সুলতানা পুতুল গতকাল বিকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে লিখেছেন, ‘ফেনী শহরে আমাদের বাড়ি। সেই বাড়িতে আমার ভাই-ভাবি আর তাদের ছোট ছোট দুটিা ছেলেমেয়ে থাকে, থাকে ভাড়াটিয়া। ফেনীতে থাকে আমার সেজো বোনও। তারও দুটো ছোট বাচ্চা। গতকাল দুপুর পর্যন্ত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেছে। এরপর থেকে আর নেই। তাদের বাড়িতে পানি ঢুকে গেছে। নিশ্চিতভাবে বাড়িতে নেই তারা। কিন্তু কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই জানি না। ভীষণ অসহায়বোধ করছি।’ আকস্মিক এ বন্যায় ফেনীতে পরিবারসহ আটকা পড়েছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনও। অনেকেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সাইফউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মোবাইলে চার্জ কম থাকায় সবার সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না এই পেসার। পরে ফেসবুকে একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিওবার্তায় ফেনীর নাজুক অবস্থা তুলে ধরে সাইফুদ্দিন বলেন, ‘পুরো শহর বিদ্যুৎহীন। অনেক চেষ্টার পর আমি আমার ফোনকে সামান্য চার্জ করতে পেরেছি। ঢাকা থেকে অনেকেই হয়তো যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। ফেনীর বিভিন্ন এলাকায় আপনার স্বজনরা চরম সংকটে রয়েছেন। পরিস্থিতি খুবই ভয়ানক। আমার ফোনের চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ায় আমি আর কতক্ষণ সংযোগ রাখতে পারব জানি না। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করুন।’

গতকাল সন্ধ্যায় ইলিয়াছ হোসেন নিলয় ফেসবুকে লিখেছেন, ফেনীতে অনেক আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ পাচ্ছি না, আল্লাহ তুমি সবাইকে রক্ষা কর। আবদুল হান্নান ফেসবুকে লিখেছেন, পরশুরামের দক্ষিণ কোলাপাড়াতে আমার ভাই ছাবের আহম্মেদ, আবদুর রউফ (সাহিদ), বোন জরিনা ও ফেনীতে আবদুর রাজ্জাক (মামুন), আবদুল মন্নান, মহিউদ্দিন, বড় কাকা অসুস্থ নাদেরুজ্জামান, চৌদ্দগ্রামে টিটু, বোন বিউটি, লাভলি, শিল্পী, ফেনীর আলোকদিয়া ভূঁঞা বাড়ি, সোনাপুর, কুমিল্লার মিয়াবাজার ও আশপাশের বাড়িসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মহান আল্লাহ রহম করেন সবার ওপর। বৃহস্পতিবার বিকালে স্বপন কুমার শিপু লেখেন, ফেনীতে আমার মামা, মামি ছোট ভাই-বোনসহ অনেক আত্মীয় স্বজনের খোঁজ পাচ্ছি না। মোবাইল ফোন থেকে বিচ্ছিন্ন, যোগাযোগ করতে পারছি না। এদিকে জাহিদ হাসান নামের এক ব্যক্তি গতকাল ফেসবুকে লিখেছেন, ফেনীর অবস্থা ধারণার চেয়েও ভয়াবহ। গ্রামের পর গ্রাম পানির নিচে ডুবে আছে। কিছু লম্বা গাছ, আর দোতলা বাড়ির চূড়া ছাড়া কিছু দেখা যায় না। ফেনীতে যথেষ্ট ভলান্টিয়ার আছে। কিন্তু তার তুলনায় ইকুয়িপমেন্ট খুবই কম। ইকুয়িপমেন্টের অভাবেই আমি ঢাকার পথ ধরলাম। গতকাল থেকে এখন অবধি সর্বোচ্চ ৪০টি বোট ঢুকছে। ভলান্টিয়ার আছে কমপক্ষে ৫০০ জন। বোটে চড়ে ভলান্টিয়াররাই যদি প্লাবন এলাকায় যায়, দুর্গতদের রেসকিউ করবে কীসে? অতিদ্রুত বোট এবং খাবার বাড়াতে হবে। সোনাগাজী এবং দাগনভূঞার মানুষদের এখনই অন্যত্র সরাতে পারলে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কমবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর