রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

মালয়েশিয়ায় বাবুর ৫০০ কোটি টাকা

আছে বাড়ি প্লট কোম্পানি

মাহবুব মমতাজী

মালয়েশিয়ায় বাবুর ৫০০ কোটি টাকা

সাবেক হুইপ ও নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনের সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে তার ডুপ্লেক্স বাড়ি, বাণিজ্যিক প্লট এবং কোম্পানি আছে। দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট নজরুল ইসলাম বাবুর টাকা পাচারের তথ্য-উপাত্ত ২০২০ সালেই মালয়েশিয়া থেকে সংগ্রহ করে। কিন্তু পরবর্তীতে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সংস্থাটির অনুসন্ধান কর্মকর্তারা জানতে পারেন যে, কয়েক বছর আগে বাবুর বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি তদন্ত করলেও ২০১৮ সালের মার্চে তাকে দায়মুক্তি দেয় দুদক। দুদকই আবার ২০১৯ সালের শেষের দিকে বাবু ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির অনুসন্ধান নতুন করে শুরু করে। দুদকের বিশেষ তদন্ত শাখা-২ এ অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধান কর্মকর্তা ছিলেন দুদকের উপপরিচালক মশিউর রহমান। বাবু সম্পর্কে তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে তথ্য চায় দুদক।

বিএফআইউর তথ্যানুুযায়ী, নজরুল ইসলাম বাবু ও তার পরিবারের সদস্যরা চারটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- মেসার্স সূচনা ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, মেসার্স স্টার ট্রেডিং কোম্পানি, মেসার্স বাবু এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স সূচনা ডায়িং প্রিন্টিং ওয়েবিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। দুদক সূত্র জানায়, বাবুর দুই ভাই, দুই ভগ্নিপতি, ভাগ্নে রাজীব, শাশুড়ি এবং দুই বন্ধুর কাছেও আছে তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ। এক ভাই ও এক বন্ধুর নামে পরিচালিত ব্যবসার নেপথ্যেও আছেন তিনি। কেমিক্যাল পণ্য আমদানিকারক ও সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিত তারা। আর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের ৯৭ পার্সিয়ারাও দোতা, দোতা নুসানতারা শ্রী হাউতোমাস এলাকায় একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি কিনেছেন বাবু। ৫ লাখ ৫ হাজার ৩১৩ ?মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ ২০ হাজার ৩৩৩ টাকায় বাড়িটি কেনা হয়েছে। কুয়ালালামপুরের পেরিনডাসট্রেইন, নিলাই-২, সেরেমবানে নজরুল ইসলাম বাবু ও তার স্ত্রী সায়মা আফরোজ ইভার নামে আছে একটি বাণিজ্যিক প্লট। ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৫৬ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি ২ লাখ ৬৫ হাজার ৩৩০ টাকায় প্লটটি কেনা হয়। এ ছাড়া কুয়ালালামপুরের জালান ডি আইএমবিআই ঠিকানায় মাজু মুহিব্বাহ নামে নজরুল ইসলাম বাবুর একটি কোম্পানি আছে। কোম্পানির নিবন্ধন নম্বর ৮৮৮৫৬-এইচ। মালয়েশিয়ার আমপাং প্রদেশেও আছে বাবু ও তার স্ত্রীর সম্পদ। এ ছাড়া প্রবাসী এক আত্মীয়ের নামে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন বাবু। জানা যায়, বাবুর দেশে যত সম্পদ আছে, এর মধ্যে ঢাকার গুলশান-১ এ ১৫ নম্বর সড়ক, প্লট নম্বর-১ এ র‌্যাংগস ওয়াটার ফ্রন্টে ৪ হাজার ২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাট নম্বর-২সি। ৮৮ শান্তিনগরে ইস্টার্ন পিয়ারে আছে ১টি ফ্ল্যাট। রমনা থানার সিদ্ধেশ্বরীর ৬৭, হাফিজ এস্টেটে আছে ২ হাজার ১৭০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল উপশহরে বাবুর আছে ১০ কাঠার প্লট। ৬১ বিজয়নগরে ইস্টার্ন আরজু নামে একটি ভবনের মালিক বাবু। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স-২ এ বাবুর আছে ৪টি দোকান (৮/১২, ৮/৪, ৮/৩৪ ও ৮/৩৯)। এই শপিং কমপ্লেক্সের আন্ডারগ্রাউন্ডে অবস্থিত ৪টি গোডাউনের মালিকও তিনি। শান্তিনগরেও আছে একটি ভবন। বাড়ি নম্বর ৯০/৯১। শেরেবাংলা নগরের ১৬৩ পূর্ব রাজাবাজারে বাবুর আছে আরও একটি ফ্ল্যাট। সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির ২৫ শতাংশ মালিকানা বাবু ও তার স্ত্রীর নামে।

দুদকের নথি থেকে জানা যায়, শেয়ারবাজারেও বিনিয়োগ আছে নজরুল ইসলাম বাবুর। তালিকাভুক্ত কোম্পানি বে লিজিং, গ্রামীণ-২ মিউচুয়াল ফান্ড, ইস্টার্ন হাউজিং এবং এসআইবিএলের উল্লেখসংখ্যক শেয়ার তার হাতে রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় ২০০৮ সালে পৈতৃকভাবে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ জমি পাওয়ার কথা উল্লেখ করেন বাবু। ২০০৮ সালে তার নামে অকৃষি জমি না থাকলেও পরে ৩৭০ দশমিক ২৯ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি। বাজবী গ্রামে ছোট ভাইয়ের নামে ৫৪০ শতাংশ জমি কিনে পরে তা নিজের নামে লিখে নিয়েছেন। ২০০৮ সালে জমি বা অন্য কোনো সম্পত্তি না থাকলেও ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৫৫ শতাংশ জমি কিনেছেন বাবুর স্ত্রী। গুলশান পোস্ট অফিসে বাবুর স্ত্রীর নামে রয়েছে ১৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। মধুমতি ব্যাংকে ২০ কোটি ও ১৫ কোটি টাকার দুটি এফডিআর। ঢাকা ব্যাংকের আড়াইহাজার কালিরবাড়ী শাখায় বাবুর বড় ভাইয়ের নামে আছে ৩০ কোটি টাকার এফডিআর। রূপগঞ্জের রূপসী মেইন রোডে ইনস্টিটিউট অব মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক বাবু ও তার স্ত্রী। বাবুর শাশুড়ির নামে নরসিংদীতে আছে ২৭৭ বিঘা জমি। সিলেটের একটি ফাইভ স্টার হোটেলের ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিক বাবু। গাজীপুরের হোতাপাড়ায় ১৪ বিঘা জমি আছে তার। জানা যায়, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। প্রথম অনুসন্ধান কর্মকর্তা ছিলেন দুদকের উপপরিচালক মো. সামছুল আলম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান দুদক উপপরিচালক ওয়াকিল আহমেদ। অনুসন্ধান শেষে অব্যাহতির সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেন তিনি। এই প্রতিবেদন কমিশনে গৃহীত হয়। ২০১৮ সালের ৫ মার্চ নজরুল ইসলাম বাবুকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্য দিয়ে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে ১১৮ জনের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। বিস্তারিত তথ্য জানতে বিএফআইইউর সহযোগিতা চাওয়া হয়। সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠান দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন। ১১৮ জনের ওই তালিকায় এমপি বাবু ও তার স্ত্রীর নাম আছে।

 

 

সর্বশেষ খবর