সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভাসছে লাশ, ত্রাণের জন্য অপেক্ষা

অনেক জায়গায় বন্যার উন্নতি, এখনো বন্দি সাড়ে ১০ লাখ পরিবার

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভাসছে লাশ, ত্রাণের জন্য অপেক্ষা

কুমিল্লার মুরাদনগরে দুর্ভোগে বন্যার্তরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

অনেক জায়গায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। বেশ কয়েকটি লাশও ভেসে উঠেছে গতকাল। বিভিন্ন স্থানে ত্রাণের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন বন্যার্তরা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব কামরুল হাসান বলেছেন, বন্যায় দেশের ১১ জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯ পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫২ লাখ মানুষ। তবে নতুন করে কোনো এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা নেই। গতকাল সচিব বলেন, সার্বিকভাবে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। নতুন করে কোনো এলাকা প্লাবিত হচ্ছে না এবং হওয়ার আশঙ্কা নেই। পানি নেমে যাওয়ার পর অনেক রোগের প্রাদুর্ভাব হতে থাকে। এ ব্যাপারে আমরা সতর্ক করেছি। প্রত্যেককে নিরাপদ পানি ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করেছি। কন্ট্রোল রুম খোলা আছে। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার একটি হিসাব খোলা আছে সেখানে যদি কেউ কিছু দিতে চান সেটি অব্যাহত আছে। সচিব বলেন, ১১টি জেলার ৭৩ উপজেলার ৫৪৫টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা বন্যায় প্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা ১৮ জন, নিখোঁজ রয়েছেন দুজন। পানিবন্দি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৩ হাজার ৬৫৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ৪ লাখ ১৫ হাজার ২৭৩ জন এবং ২২ হাজার ২৯৮টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ৭৪৮টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে বলেও জানান তিনি। কামরুল হাসান জানান, ফেনীতে একটি ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। ত্রাণ সচিব বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে ১১ জেলায় ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ২০ হাজার ৬৫০ মেট্রিক টন চাল, ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনা ও অন্যান্য খাবার, ৩৫ লাখ টাকার শিশুখাদ্য এবং ৩৫ লাখ টাকার গো-খাদ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায় থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। সচিব বলেন, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসককে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, মেডিকেল টিম ও অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে একসঙ্গে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া ও পরশুরাম উপজেলায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌ ও সড়ক পথে এবং তাদের হেলিকপ্টারসহ বিমানবাহিনী, র?্যাব ও বিজিবির হেলিকপ্টারে প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে। পাশাপাশি উদ্ধার কার্যক্রম চলমান আছে। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- কুমিল্লার তিতাসে বন্যার পানির স্রোতে তলিয়ে দুই বোনের মৃত্যু : কুমিল্লার তিতাসে মাদরাসা থেকে ফেরার পথে বন্যার পানির প্রবল স্রোতে ভেসে দুই চাচাতো বোন মারা গেছেন। রবিবার দুপুরে  উপজেলা বাগাইরামপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। তারা ওই গ্রামের প্রবাসী মনির হোসেনের মেয়ে আয়েশা আক্তার (১০) ও মোক্তার হোসেনের মেয়ে ছামিয়া আক্তার (৯)। তারা নয়াকান্দি ইসহাকিয়া সহিনিয়া দারুল কোরআন মাদরাসার ছাত্রী। বুড়িচংয়ে ভেসে এলো লাশ : কুমিল্লায় বন্যার পানিতে একটি লাশ ভেসে আসতে দেখা গেছে। গতকাল সকালে জেলার বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের আগানগর গ্রামে লাশটি ভাসতে দেখা যায়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বুড়িচং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার আবুল হাসনাত। তিনি জানান, লাশটি উদ্ধার করা হয়েছে। এটি একটি পুরুষের লাশ। তার বয়স ৪৫ থেকে ৫০-এর মধ্যে। তাকে আগে বুড়িচং বাজারের দিকে ভবঘুরে হয়ে ঘুরতে দেখতেন স্থানীয়রা।

কুমিল্লার দক্ষিণের বন্যার্তদের হাহাকার : কুমিল্লার বন্যা আক্রান্ত এলাকার বাজারে ফুরিয়ে আসছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। নিচু জায়গার বেশির ভাগ বাজার পানির নিচে। আর উঁচু জায়গার বাজারগুলোতে গত কয়েকদিন ধরে শুকনো খাবারের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে টান পড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য চাল, ডাল, আলু, তেল, পিঁয়াজ, রসুনসহ প্রায় সব পণ্যের। বন্যার কারণে সরবরাহ ব্যাঘাত ঘটায় বন্যা আক্রান্ত এলাকার অপেক্ষাকৃত উঁচু বাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই বললেই চলে। এ ছাড়া জরুরি ওষুধের সংকটও দেখা দিয়েছে। যার কারণে দূর-দূরান্তের বাজারগুলো থেকে চড়া দামে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক এবং সাধারণ মানুষদের। তিন দিন বৃষ্টি না থাকলেও গতকাল দুপুরে কুমিল্লায় বৃষ্টি হয়েছে। গোমতীর বাঁধ নিয়ে শঙ্কায় নগরবাসী : ভাঙনের পরও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে গোমতী নদীর পানি। এতে নদীর বাঁধ দিয়ে  চুইয়ে পানি বের হচ্ছে। এ নিয়ে দুঃচিন্তার শেষ নেই শহরবাসীর। গতকাল সরেজমিন কুমিল্লার গোমতী নদীর বিবির বাজার, চানপুর ও ভাটপাড়া এলাকায় ঘুরে দেখা যায় নদীরক্ষা বাঁধে স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছেন। কয়েকদিন ধরে কুমিল্লা শহরতলির শুভপুর চাঁন্দপুর, কাপ্তান বাজার, ভাটপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছেন। কখন গোমতীর বাঁধ ভেঙে শহরে পানি প্রবেশ করে এ শঙ্কায় রয়েছেন তারা। লক্ষ্মীপুরে ত্রাণের জন্য হাহাকার : লক্ষ্মীপুরে স্মরণকালের সেরা বন্যা মোকাবিলা করছে মানুষ। জেলা সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর, রামগতি ও রায়পুরে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ৭ লাখ মানুষ। নতুন করে তেওয়ারিগঞ্জ, কুশাখালী, বশিকপুর, মান্দারী, দিগুলি, টুমচর, শাকচর ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এর আগে রামগতি, কমলনগর, রায়ুপুর, রামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হলেও পানি এখনো কমছে না। এসব এলাকার বাসিন্দারা চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে ত্রাণ বিতরণ করছেন বন্যার্তদের মাঝে। তবে অনেকেই এখনো ত্রাণ পাননি বলে জানান।

জেলা ত্রাণ  ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়া জানান, এখন পর্যন্ত ৯ হাজার মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যার্তদের মাঝে ৪১৯ মেট্রিক টন  চাল, নগদ ১০ লাখ টাকা ও শুকনো খাবার  বিতরণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি : গত ২৪ ঘণ্টায় টানা বৃষ্টি ও ফেনীর উজানের পানিতে নোয়াখালীর বন্যা পরিস্থিতি আবারও অবনতি হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে আটটি উপজেলার মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব উপজেলায় ইতোমধ্যে ৮২৬টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ১ রাখ ৫৩ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। জেলায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। এর মধ্যে দুই শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। জেলা প্রশাসন ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার দিয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন। হবিগঞ্জে ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন : হবিগঞ্জে জেলায় কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। ইতোমধ্যে অনেক বাসাবাড়ি ও সড়ক থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদনদীর পানি। বন্যার পানি কমে যাওয়ায় অনেক লোকজন তাদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে। তবে বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় ভেসে উঠছে সড়ক, বাড়িঘরসহ নানা স্থাপনার ক্ষতচিহ্ন। কসবা ও আখাউড়ায় পানি আরও কমেছে : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও আখাউড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। গতকালও পানি কমেছে দুই উপজেলাতেই। কসবায় কিছু সড়কে পানি থাকলেও বেশির ভাগ জায়গার বাড়িঘর থেকে পানি সরে গেছে। চট্টগ্রামে এখনো পানিবন্দি কয়েক লাখ মানুষ : চট্টগ্রামে এখনো পানিবন্দি হয়ে আছে লাখ লাখ মানুষ। চট্টগ্রামের ১২ উপজেলার ১০১ ইউনিয়নের প্রায় ৩ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। গতকাল বিকাল থেকে মীরসরাই, সীতাকুন্ড ও ফটিকছড়ির কিছু এলাকায় পানি কমে আসছে। তবে পুরোপুরি কমে আসতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রেল যোগাযোগ বন্ধ : বন্যার কারণে চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগ এখনো বন্ধ আছে। রেললাইনগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় রেল চলাচল শুরু করতে পারেনি।

চকরিয়ায় শিশুর ভাসমান লাশ উদ্ধার : কক্সবাজারের চকরিয়ায় নিখোঁজের ২৬ ঘণ্টা পর আবদুল্লাহ আবির রাইয়ান (১২) নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার হয়েছে। গতকাল দুপুর ২টার দিকে বাড়ির পার্শ্ববর্তী চিংড়ি ঘের থেকে ভাসমান অবস্থায় ও-ই শিশুর লাশ উদ্ধার করে পরিবারের লোকজন।

 

 

সর্বশেষ খবর