মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা

কারাগারে ৩৯০ আনসার, আসামি ১০ হাজার

হাসপাতালে আহতদের দেখতে গেলেন চার উপদেষ্টা ♦ আনসারের ছদ্মবেশে যারা এসেছিল তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিশৃঙ্খলা করা : আসিফ নজরুল

নিজস্ব ও আদালত প্রতিবেদক

কারাগারে ৩৯০ আনসার, আসামি ১০ হাজার

আহত ছাত্রদের দেখতে গতকাল হাসপাতালে যান উপদেষ্টারা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে সচিবালয় অবরুদ্ধ করে ভাঙচুর ও হামলার মামলায় গ্রেপ্তার ৩৯০ জন আনসার সদস্যকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের পৃথক কয়েকটি আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এদিকে রাজধানীর তিন থানায় পৃথক মামলায় প্রায় ১০ হাজার অজ্ঞাত আনসার সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখা সূত্রে জানা গেছে, এদিন শাহবাগ থানার মামলায় ১৯১ জন, রমনা থানার মামলায় ৯৮ জন, পল্টন থানার মামলায় ৯৫ জন ও বিমানবন্দর থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো ছয়জন আনসার সদস্যকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এ চার থানার মামলায় অন্তত ৪২৬ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়াও অন্তত ৩ হাজার অজ্ঞাতনামা আনসার সদস্যদের আসামি করা হয়েছে। মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, রবিবার রাত ৯টার দিকে বাংলাদেশ সচিবালয়ের সামনে সাধারণ আনসার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় আনসার সদস্যরা পল্টন মডেল থানাধীন জিরো পয়েন্ট এলাকায় চাকরি জাতীয়করণসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজপথ অবরোধ করে রাখে। পুলিশ তাদের ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুরোধ অমান্য করে রাস্তা অবরোধের মাধ্যমে যান চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ অন্যান্য উপদেষ্টারা তাদের দাবিদাওয়ার প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সাধারণ আনসারদের পক্ষে কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে তাৎক্ষণিক বৈঠক করেন এবং আংশিক দাবি পূরণ করেন। এ ছাড়াও অন্যান্য যৌক্তিক দাবিগুলো একটি কমিটি গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নে আশ্বাস দেন। কিন্তু সাধারণ আনসাররা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তথা বাংলাদেশ সচিবালয়ের চারপাশে অবস্থান করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে এবং জিরো পয়েন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অবরোধ করে দাবিদাওয়া পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করবে মর্মে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে।

একপর্যায়ে রাত সাড়ে ৯টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা ঘটনাস্থলে এলে তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে অসংখ্য পথচারী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা গুরুতর আহত হন। আনসার সদস্যরা রাস্তার ওপর আগুন ধরিয়ে দেয় এবং রাস্তায় চলাচলরত বিভিন্ন গাড়ি ভাঙচুর করতে থাকে। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে বেআইনি জনতাবদ্ধ হয়ে পুলিশের কাজে বাধা, অগ্নিসংযোগ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে গাড়ি ভাঙচুর করে। এর আগে চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে আন্দোলন করা সাধারণ আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে রাজধানীর তিন থানায় পৃথক মামলা হয়। এসব মামলায় প্রায় ১০ হাজার অজ্ঞাত আনসার সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।  গতকাল শাহবাগ থানা সূত্রে জানা যায়, সচিবালয়ে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ২০৮ জন ও অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ৩ হাজার আনসার সদস্যকে। এ ছাড়া শাহবাগ থানায় ১৮৯ জন আনসার সদস্য গ্রেপ্তার হন। পল্টন থানার মামলায় এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে ১১৪ জন আনসার সদস্যকে। এ ছাড়া মামলায় ৪ হাজার আনসার সদস্যকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। রবিবার রাত থেকে গতকাল পর্যন্ত ৯৫ জন আনসার সদস্যকে পল্টন থানায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। রমনা থানার মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ৯৮ জন এবং অজ্ঞাত আসামি ৩ হাজার। রমনা থানায় গতকাল পর্যন্ত ৮৫ জন আনসার সদস্য গ্রেপ্তার হন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. সারোয়ার জাহান বলেন, তিন থানায় আন্দোলনরত আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলায় তাদের বিরুদ্ধে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ আনা হয়েছে।

ঢামেকে ভর্তি দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক : রাজধানীর সচিবালয়ে আনসার-ছাত্র সংঘর্ষে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুজন শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। গত রবিবার সংঘর্ষে আহত হয়ে ৬০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন ঢামেক হাসপাতালে। এর মধ্যে পাঁচজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে গতকাল হাসপাতালে গিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টা।

অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান হাসপাতালে ভর্তি থাকা আহতদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন।

এ সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, সচিবালয়ে আনসার ও ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষে ৬০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিনি আরও বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া প্রায় ২ হাজার ব্যক্তি ঢামেক থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৮০০ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল। বর্তমানে হাসপাতালে ১০০ জন গুলিবিদ্ধসহ চিকিৎসাধীন রয়েছেন, যাদের মধ্যে আইসিইউতে নয়জন আছেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান আরও জানান, আইসিইউতে থাকা রোগীদের অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সব রোগীর জন্য চিকিৎসাসেবা সম্পূর্ণ ফ্রি করা হয়েছে। যেসব ওষুধ সরকারিভাবে সরবরাহ করা হয় না, সেগুলোরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঢামেকে আহতরা যেন সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা পান, সেজন্য তাদের জন্য একটি ডেডিকেটেড ওয়ার্ড তৈরি করা হয়েছে। তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান, যেন হাসপাতালে অযথা ভিড় না করেন এবং রোগীদের সঙ্গে একজন করে অ্যাটেনডেন্ট থাকেন। আহতরা বিভিন্ন জীবাণুতে আক্রান্ত হতে পারেন, তাই সবার সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

আনসারের ছদ্মবেশে যারা এসেছিল তাদের উদ্দেশ্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি-ড. আসিফ নজরুল : অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, সচিবালয়ে যারা আনসারদের ছদ্মবেশে এসেছিল তাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। যারা ষড়যন্ত্র করতে এসেছিল তারা সফল হবে না। প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) শিক্ষার্থী-আনসার সংঘর্ষে আহতদের দেখতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, ঢামেকের পরিচালক ও শিক্ষার্থী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

ড. আসিফ নজরুল বলেন, যারা আনসারের ছদ্মবেশে এসেছিল, তাদের দাবি আদায়ের এজেন্ডা ছিল না। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। লাঠি তাদের স্টকে ছিল। আমরা দেখেছি, কীভাবে তারা ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে। যেসব ছাত্র স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে, যারা আমাদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ, তাদের রাস্তায় ফেলে নির্মমভাবে মেরেছে।

তিনি আরও বলেন, ছাত্ররা পুরো পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। যারা ষড়যন্ত্র করবে, তারা সফল হবে না। প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে যারা সঠিক পথে দাবি আদায়ের আন্দোলন করছেন, আপনাদের কাছে অনুরোধ, বিবেচনা করে দেখবেন ১৭ বছরের বৈষম্য ও শোষণ ১৭ দিনে কি সমাধান করা যায়? আনসারদের ধৈর্য্য ধারণের পরামর্শ দিয়ে এই উপদেষ্টা বলেন, আপনারা নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় দাবি জানান। আমরা জনগণের পক্ষ থেকে এসেছি, কোনো দলের প্রতিনিধি না। সবার স্বার্থ নিশ্চিত হয় এমনভাবে কাজ করব। তবে সেজন্য সময় লাগবে। অধ্যাপক আসিফ নজরুল আরও বলেন, সচিবালয়ে শিক্ষার্থী-আনসার সংঘর্ষে আহত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর শারীরিক অবস্থা অনেকটা ভালো। হাসনাত ছাড়া আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী ও পথচারী চিকিৎসাধীন আছেন। আহতদের সুচিকিৎসায় সব রকমের সহযোগিতা করা হবে।

 

 

 

 

সর্বশেষ খবর