আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে না। গতকাল সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে, তখন আপনি দেখেছেন আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমি না, যদি না কোনো জঙ্গিবাদী কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় তারা লিপ্ত থাকে।’ উপদেষ্টা বলেন, সত্যিকার অর্থে যদি কোনো রাজনৈতিক দল জঙ্গিবাদী কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় জড়িত থাকে, তাহলে প্রচ- সততার সঙ্গে তদন্ত করে এমন কিছু (নিষিদ্ধ) করা যেতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সংগঠন করার স্বাধীনতার বিষয়টি তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল, বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তাদের অবদান ছিল। কিন্তু গেল ১৫ বছরে তারা যা করেছে, সেটা তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যায় না, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বর্বরতম ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ। এ কর্মকান্ডের জন্য ব্যক্তিগত দায় থাকতে পারে, নেতাদের সামষ্টিক দায় থাকতে পারে, কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে বলে আমি মনে করি না।
একটি দলকে কখন সন্ত্রাসী সংগঠন বলা উচিত- এমন প্রশ্নে আইন উপদেষ্টা বলেন, যারা বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি নস্যাৎ করতে চায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বৈষম্যহীন ও শোষণহীন সমাজকে ধ্বংস করার জন্য যারা পরিকল্পিতভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম করে, তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন বলা উচিত। তবে মতামত প্রকাশ যতটা অবারিত রাখা যায়, ততটাই ভালো। জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, আওয়ামী লীগ এটা কখনোই করে নাই। ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু কখনোই করে নাই। তারপর এমন একটা বিশেষ মুহূর্তে তারা এটা করেছে, তখন ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান চলছিল। তিনি বলেন, তারা ছাত্র-জনতার এই গণ অভ্যুত্থানকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, জামায়াত, বিএনপি, জঙ্গিদের সন্ত্রাস’ আখ্যায়িত করে এ আন্দোলনেক নির্মমভাবে দমন করার চেষ্টায় রত ছিল। তারা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে হঠাৎ করে একটা প্রজ্ঞাপন জারি করে। আওয়ামী লীগ যে গণ অভ্যুত্থানকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বলতে চেয়েছে, আমরা তো সেটার পার্ট হতে পারি না। আসিফ নজরুল বলেন, আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগ কোনো নীতিগত অবস্থান থেকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে নাই। তারা রাজনৈতিক অপকৌশলের জন্য, আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করার জন্য এই ইস্যুটাকে এভাবে ব্যবহার করেছে। তিনি বলেন, আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তারা পরীক্ষা করে দেখেছে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যেভাবে ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল, জঙ্গি তৎপরতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল এটার ভিত্তিতে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা সত্যি না। এটা ছাত্র-জনতার বিপ্লব ছিল। ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হিসেবে একটা দলের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাকে নিষিদ্ধ করা, আমরা এই মিথ্যা ন্যারেটিভের পার্ট হতে পারি না।
বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের আদালতে তোলার সময় আইনজীবীরা যে বিশৃঙ্খা করছেন- সে বিষয়ে আইন উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আদালত চত্বরের হামলাগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। এখন মানুষের এত ক্ষোভ, এত ক্রোধ এগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেটাকে সমর্থন করছি না। আমি পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি, আপনারা বাধা দিচ্ছেন না কেন? তারা বলল, যে জনতা আছে, তাদের যদি যথেষ্ট বাধা দেয়, তাহলে পরিস্থিতি তো অন্যদিকে মোড় নেবে। আগের সরকার পুলিশকে জনগণের এত বড় শত্রুতে রূপান্তর করেছিল যে পুলিশ সাহস করে তাদের বাধা দিতে পারে না। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আসিফ নজরুল বলেন, এটাও তো আওয়ামী লীগই শুরু করেছিল, ঠিক না? আমিনুল যে ফুটবলার, সাকিব তো আর বাংলাদেশে রাষ্ট্রের জন্য কিছু বয়ে আনেনি। সাকিব নিজে অনেক কিছু অর্জন করেছে। আর আমিনুল রাষ্ট্রের জন্য পুরস্কার বয়ে এনেছে, জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন ছিল। আমিনুলকে যেভাবে অত্যাচার করা হয়েছিল, তখন কি আপনারা প্রশ্ন করেছিলেন? আমিনুলকে জেলেও মারা হয়েছে। সাকিবের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে শুধু। তিনি বলেন, মামলা বা এফআইআর হওয়া মানেই কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়া না। আমার বিশ্বাস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালায় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে যাতে কেউ অতি উৎসাহিত হয়ে গ্রেপ্তার করতে না যায়।সংঘর্ষের মধ্যে হতাহতের ঘটনায় বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী, পুলিশ কর্মকর্তাদের আসামি করার বিষয়ে এক প্রশ্নে আসিফ নজরুল বলেন, ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি মামলা করে, ধরেন, আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আপনার সন্তান মারা গেছে। এখন আপনার সন্তান যদি মারা গিয়ে থাকে, তাহলে যে এলাকায় মারা গেছে, শুধু সেই এলাকার পুলিশকেই মামলা দেবেন? আপনি তো দেখেছেন আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলেছেন, ওবায়দুল কাদের কী বলেছেন, দীপু মনি, নওফেল, আরাফাত কী বলেছেন, আপনার মনে পড়বে না?
তিনি বলেন, এখন আপনি যদি উনাদের বিরুদ্ধে মামলা দেন, রাষ্ট্রের কোনো অধিকার নাই ‘আপনি মামলা করতে পারবেন না’ বলার। আমাদের একটাই করণীয় আছে, পুলিশের কাছে মামলা হলে পুলিশ তদন্ত করবে। সুস্পষ্ট তথ্য না পেলে পুলিশ ডিসচার্জ করে দেবে। আদালতের কাছে যদি মামলা দেয়, আদালত তদন্তপূর্বক এফআইআর দিতে বলবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের যে কাজ, আমরা তদন্ত বা বিচার কাজে ডিউ প্রসেস বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করব। আপনাদের কাছে এটা আমার কমিটমেন্ট। এখন আমরা তো আদালতের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারি না। আমরা এমনও শুনেছি, আদালতের ওপরও চাপ আছে। স্থানীয় পর্যায়ে একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী, যার অত্যাচারে ১৫ বছর মানুষ অতিষ্ঠ ছিল। তারা চায় যে এক্ষুনি তার বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া হোক। আদালত তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে এসব চাপ এড়ানোর জন্য। আপনারা মনে কইরেন না আমরা কেউই চেষ্টা করছি না। আমরা চেষ্টা করছি।