রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করতে কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি (গণপরিষদ) করে হলেও সংবিধান পুনর্লিখন জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ও সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. আলী রীয়াজ। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে সিজিএস আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের কারণে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে। বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচনব্যবস্থা- সবই পরিকল্পিতভাবে রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। বিগত সময়ে এমন সব নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে, যা জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে। ঋণ খেলাপিদের বিচার থেকে রক্ষা করা হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে বিপদাপন্ন করেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে একে একে ধ্বংস করা হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও জ্বালানি খাতে স্বার্থবাদী একটি নেটওয়ার্ক গঠিত হয়েছিল, যারা নিজেদের স্বার্থে এই গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর ক্ষতি করেছে। জ্বালানি খাতের ভর্তুকি পকেটে ভরেছে বিগত সরকারের সঙ্গে যুক্ত একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। এসব কারণে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করতে হলে সংবিধানের পুনর্লিখনের বিকল্প নেই। সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছি এই কারণে যে, বর্তমান সংবিধান সংশোধনের উপায় সীমিত। কারণ, সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ এমনভাবে লেখা যে, তাতে হাতই দেওয়া যাবে না। এর মধ্যে এমন সব বিষয় আছে, যেগুলো না সরালে কোনো কিছুই করতে পারবেন না। এ কারণে পুনর্লিখন শব্দটা আসছে। আর পুনর্লিখনের পথ হিসেবে কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলির কথা বলছি। আর কোনো পথ আমার জানা নেই। তিনি বলেন, গণজাগরণের মাধ্যমে তৈরি হওয়া আশা ও প্রত্যাশা পূরণ করতে সরকারের ওপর বিশাল দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সংবিধানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
সরকারপ্রধান হিসেবে একজন সর্বোচ্চ কত মেয়াদে থাকতে পারবেন, এমন প্রশ্ন উঠলে এই অধ্যাপক বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সরকারপ্রধান হিসেবে একই ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ থাকতে পারেন।’ টিআইবির প্রস্তাবিত একই ব্যক্তি ‘দলীয় প্রধান, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না’- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আলী রীয়াজ বলেন, ক্ষমতা যাতে এক হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, সেটাই টিআইবি বলেছে। এসব সংস্কার জরুরি। ক্ষমতা কেন্দ্রভূত করার পথ সাংবিধানিকভাবে বন্ধ করা না হলে ভবিষ্যতে আরও স্বৈরাচার তৈরির পথ বন্ধ করা যাবে না। ভারতীয় গণমাধ্যমের অপতথ্য প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, ‘ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো ৫ আগস্ট থেকে যেসব অপতথ্য (ডিসইনফরমেশন) ও ভুল তথ্য (মিসইনফরমেশন) প্রচার করছে, সেগুলোর বড় জবাব হচ্ছে সত্য ঘটনা তুলে ধরা। আপনারা সত্য তথ্য তুলে ধরুন।’ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নাগরিক সংলাপের যে আহ্বান জানিয়েছেন, সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ড. আলী রীয়াজ বলেন, টেকসই গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংলাপের আয়োজন করে সেগুলোর মাধ্যমে দেশব্যাপী নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ এবং বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শ সংগ্রহ করা হবে। তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ প্রণয়ন সম্ভব হবে, যা গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে সহজ এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। আগামী পাঁচ মাস জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সিজিএস ধারাবাহিক সংলাপের আয়োজন করবে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় পর্যায়ের সংলাপের অংশ হিসেবে ঢাকায় আটটি ও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ও খুলনায় চারটি আঞ্চলিক সংলাপ হবে। এতে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের প্রত্যাশা, প্রস্তাবনা ও সুপারিশ খোলাখুলি প্রকাশ করতে পারবেন। এতে বিষয়বস্তুর মধ্যে থাকছে সংবিধান, মানবাধিকার ও গুরুতর আইন লঙ্ঘনের শিকার ভুক্তভোগীদের বিচার নিশ্চিতকরণ, বিচারব্যবস্থা, নাগরিক প্রশাসন, সাংবিধানিক সংস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, অর্থনৈতিক নীতিমালাসহ ব্যাংকিং খাত ও বৈদেশিক ঋণ এবং গণমাধ্যম। প্রতিটি সংলাপের আলোচনা ও নির্দিষ্ট সুপারিশের সার-সংক্ষেপ সিজিএস প্রকাশ করবে এবং গণমাধ্যমে প্রকাশের মাধ্যমে তা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবে। সংবাদ সম্মেলনে সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, আমাদের অনেক কিছু করার আছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে চাই। সে লক্ষ্যে সিজিএস ধারাবাহিক সংলাপের আয়োজন করেছে।