শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা
গুম প্রতিরোধ দিবস

বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ ও ভিকটিমের মুক্তি দাবি

প্রতিদিন ডেস্ক

গুম প্রতিরোধ দিবসে স্বজনহারা মানুষের অশ্রুতে সিক্ত হলো ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর। সন্তানহারা মা, নিখোঁজ বাবার সন্তান, তুলে নিয়ে গেছে এমন ভাইয়ের বোন, বেহদিস স্বামীর স্ত্রী-এমন অনেকের কান্নায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পরিবেশ ছিল বেদনাবিধুর। তাঁরা সমবেত হয়েছিলেন আপনজনদের ফিরে পাওয়ার দাবি নিয়ে। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে স্বজনহারা মানুষেরা জানতে চান, স্বজনেরা কোথায় আছেন? কেমন আছেন? বেঁচে আছেন কি না? মেরে ফেলা হলে কোথায় তাঁদের কবর দেওয়া হয়েছে? তাঁরা বলেন, বাংলাদেশে যেন আর কোনো অজুহাতেই এমন অমানবিক গুমের ঘটনা না ঘটে। একজন মানুষও যেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার না হন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম হওয়া স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ গতকাল আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে। সমাবেশে তাঁরা এসব কথা বলে। অনুষ্ঠানে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া মাইকেল চাকমা, সাবেক কূটনীতিক মারুফ জামান, সংগীতশিল্পী রানা যোগ দিয়ে নিজেদের গুম হওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে সংহতি প্রকাশ করতে এসেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠনের নেতাসহ ব্যক্তিগতভাবে অনেকে। তাঁদের মধ্যে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজুল ইসলাম, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের ফয়জুল হাকিম, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের জ্যেষ্ঠ গবেষক তাসকিন ফহমিনা, আইনজীবী সারা হোসেন, সংগীতশিল্পী সায়ান, সাংবাদিক সায়দিয়া গুলরুখ প্রমুখ।

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমাদের সৌভাগ্য যে ‘আয়নাঘর’ থেকে মাইকেল চাকমা ফিরে আসতে পেরেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনেকেই ফিরে আসেননি। কেবল ঢাকায় নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘আয়নাঘর’ এখনো রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর নতুনভাবে যে জাগরণ তৈরি হয়েছে এটিকে অনেকেই স্বাধীনতা বলে আখ্যায়িত করছেন। কিন্তু এমন সময়েও যদি স্বজনহারা ব্যক্তিরা তাদের স্বজনদের ফিরে না পান, তাহলে সেই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে।

মানববন্ধনে স্বজনহারা জামাল উদ্দিন বলেন, ২০১৭ সালে আমার ছেলে ইশরাক উদ্দিনকে তুলে নেওয়া পর থেকে পরিবারের সব আনন্দ, উৎসব হারিয়ে গেছে। ২০১৪ সালে গুম হওয়া আবদুল কাদেরের মা আয়েশা আলী ছেলের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, ‘সবাই বলছে দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমার জন্য এখনো স্বাধীন হয়নি। আমি আমার ছেলেকে ফিরে পাইনি। জানি না, সে বেঁচে আছে কি নাই।’

ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলমের মেয়ে মাহফুজা আক্তার বলেন, ১৫ বছর হলো আমার বাবা নিখোঁজ। আমাদের পরিবারটাই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। কিশোরী লামিয়া আক্তার জানায়, ২০১৩ সালে তার বাবা কাওসার হোসেনকে যখন তুলে নেওয়া হয়, তখন তার বয়স ছিল তিন বছর। বাবার মুখটা তার মনে পড়ে না। কাঁদতে কাঁদতে বাবার মুখটা দেখার আকুতি জানায় লামিয়া। বলে, ‘আমি বাবার মুখটা দেখতে চাই। বাবা বলে ডাকতে চাই।’ নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন গুম অবস্থা থেকে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া মাইকেল চাকমা। সৈয়দা শাম্মি সুলতানা বলেন, ২০১৩ সালে তাঁর স্বামী খালেদ হাসানকে তুলে নেওয়ার পর থেকে শুধু কান্না নিয়েই দিন কাটছে তাঁর সংসারে। রিনা আলম বলেন ২০১৫ সালে তাঁর স্বামী নূর আলমকে তুলে নেওয়ার পর থেকে কত জায়গায় যে খোঁজ করতে ছুটে গেছেন সেই যন্ত্রণার কথা। তিনি বলেন, স্বামী যদি মারাও গিয়ে থাকেন, তাহলে অন্তত তাঁর কবরটি কোথায় আছে, তা জানতে পারলে সন্তানদের নিয়ে কবর জিয়ারত করতে পারতাম। হাসিনা বেগমের ছেলে তরিকুল ইসলামকে গুম করা হয় ২০১৩ সালে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার পরিচয়ই হয়ে গেছে গুমের ছেলের মা।’ এভাবেই স্বজন হারানোর বেদনা ও কষ্টের কথা বলে তাঁদের মুক্তি দাবি করে বক্তব্য দিয়েছেন ছেলেহারা নূরুল ইসলাম, ভাইহারা মো. শহীদুল্লাহ, সন্তানহারা রেহেনা আক্তার, ভাইহারা সঈদুল ইসলাম, বাবাহারা মিমসহ অনেকে। তাঁরা বলেন, স্বজনদের ফিরে না পেলে তাঁদের কাছে এ গণ অভ্যুত্থান, এ নতুন স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।

সমাপনী বক্তব্যে মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বলেন, ২০১৩ সালে তাঁর ভাইকে গুম করা হয়েছে। তখনই গুম হওয়া স্বজনদের নিয়ে এ সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এতদিন তাঁরা তাঁদের বেদনার কথা বলতে পারতেন না। অবিলম্বে সব আয়নাঘর, সব বন্দিশালা ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের অর্থে কোনো বাহিনী যেন কোনো বন্দিশালা গড়ে তুলতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। গুম হওয়া মানুষের মুক্তি ও তাঁদের বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশ করতে হবে।

নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা জানান, গুমের শিকার সাতক্ষীরার হোমিও চিকিৎসক মোখলেসুর রহমান জনি এবং যশোরের বেনাপোলের কলেজছাত্র রেজোয়ান হোসেনকে ফেরত পেতে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ চেয়েছেন স্বজনরা। গতকাল গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে খুলনায় মানববন্ধন ও সমাবেশে অংশ নিয়ে তাঁরা এ দাবি জানান।

খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ ও গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব ও দিবসের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধিকারের খুলনার ফোকালপারসন সাংবাদিক মুহাম্মদ নূরুজ্জামান। পরিচালনা করেন সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী কে এম জিয়াউস সাদাত। বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনা জেলা সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা আহ্বায়ক মুনীর চৌধুরী সোহেল, মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাক রানা।

সর্বশেষ খবর