মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

সীমিত সেবা সীমাহীন দুর্ভোগ

♦ হাসপাতালে অসহায় রোগী-স্বজনরা ♦ জরুরি বিভাগে ভিড় ♦ বহির্বিভাগ চলবে ৩ ঘণ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সীমিত সেবা সীমাহীন দুর্ভোগ

চিকিৎসকদের কর্মসূচিতে রোগীদের ভোগান্তি। ঢামেকে সেনা প্রহরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক), শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বেশ কিছু হাসপাতালে চিকিৎসক আন্দোলনে বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন রোগীরা। তবে জরুরি বিভাগ চালু থাকায় সীমিত পরিসরে মিলেছে সেবা। আজ থেকে বহির্বিভাগ, ইনডোর এবং রুটিন সেবা সীমিত পরিসরে চালু থাকবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

গতকাল সকাল ১০টায় ঢামেকের বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, টিকিট কাউন্টারে তালা ঝুলছে। কাউন্টারের সামনে অপেক্ষমাণ রয়েছে ১০-১২ জন রোগী ও স্বজনরা। বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা নিয়ে এসেছেন এই রোগীরা। বহির্বিভাগ থেকে সেবা না পেয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কাউকে আবার হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে দেখা যায়।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২ হাজার ৬০০ আসনের এই হাপাতালে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার রোগী সেবা নিতে আসেন। বহির্বিভাগে সেবা না পেয়ে জরুরি বিভাগে ভিড় করেন রোগীরা। এতে অন্যদিনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি রোগীর চাপ পড়ে জরুরি বিভাগে। এত রোগীর সেবা দিতে হিমশিম পরিস্থিতিতে পড়তে হয় জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের। গত সপ্তাহে আশুলিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছিলেন সালাম মিয়া। সেলাই কাটা এবং পরবর্তী ওষুধের জন্য গতকাল হাসপাতালে এসেছিলেন তিনি। সালাম মিয়া বলেন, বহির্বিভাগে গিয়ে দেখি বন্ধ, কোনো চিকিৎসক নেই। ওখান থেকে জরুরি বিভাগে এসেছি। কিন্তু এখানে ভীষণ ভিড়। প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও সিরিয়াল আসেনি। একই অবস্থা দেখা যায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। সকাল ৯টায় হাসপাতালের বহির্বিভাগে টিকিটের জন্য অপেক্ষা করেন কয়েক শ রোগী। চিকিৎসকদের আন্দোলনের কথা শুনে অনেকেই ফিরে যান। যারা জরুরি রোগী নিয়ে এসেছেন তারা জরুরি বিভাগে গিয়ে ভিড় করেন।

তবে আজ থেকে সীমিত পরিসরে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বহির্বিভাগ চালু থাকবে বলে জানিয়েছেন নিউরোসার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. আবদুল আহাদ। গতকাল বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেছেন। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, চিকিৎসকদের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে এবং হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। এরই মধ্যে আমরা দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখেছি। ইতোমধ্যে ঘটনায় জড়িত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাসপাতালে হামলার ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি যারা আছে তাদেরও দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঢামেক হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল হাসপাতালের ডেন্টাল কলেজে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে রবিবার সন্ধ্যা থেকে সব হাসপাতালে জরুরি বিভাগ চালু হয়েছিল, সেগুলো চালুই থাকবে।

ডা. আবদুল আহাদ বলেন, মঙ্গলবার থেকে সীমিত পরিসরে অর্থাৎ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বহির্বিভাগে সেবাদান চালু থাকবে। সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের অবস্থান কর্মসূচি চলবে।

চিকিৎসকদের দাবি অনুযায়ী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোর (বহির্বিভাগ) ছাড়া অন্য সব বিভাগ চালু আছে। মঙ্গলবার থেকে বহির্বিভাগসহ অন্য সেবাও চালু হয়ে যাবে। চিকিৎসকদের দাবি অনুযায়ী হাসপাতালে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় হওয়া মামলার এক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের দ্রুত ধরার চেষ্টা চলছে।

ঢাকা মেডিকেলে রোগী মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকদের কোনো অবহেলা ছিল না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ টি এম সাইফুল ইসলাম। গতকাল দুপুরে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা জানান, সোমবারই তারা উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পূর্ণ তদন্ত করেন এবং রাতেই প্রতিবেদন দাখিল করেন। যেখানে উঠে এসেছে ছাত্রদের হাতে চিকিৎসক নাজেহাল হওয়ার বিষয়টি। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনার জন্য মন্ত্রণালয় সুপারিশ করেছে বলে জানান তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত শনিবার রাতে তিন দফায় চিকিৎসকদের ওপর হামলা ও মারধরের প্রতিবাদে রাতেই কাজ বন্ধ করে দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। তখন থেকেই সেখানে চিকিৎসা সেবার অচলাবস্থা শুরু হয়। ঢাকা মেডিকেলের অন্য চিকিৎসকরাও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের এই কর্মবিরতিতে সংহতি জানান। চিকিৎসকেরা হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির পাশাপাশি সারা দেশে চিকিৎসক ও রোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান।

রবিবার দুপুরে তারা সারা দেশের সব হাসপাতালে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সঙ্গে ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন। এরপর সন্ধ্যায় সংকট নিরসনে হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে কর্মবিরতি স্থগিতের ঘোষণা দেন চিকিৎসকরা। এসব শর্ত না মানা হলে সোমবার সন্ধ্যা থেকে ‘শাটডাউন’ কর্মসূচিতে ফিরবেন বলে তারা হুঁশিয়ারি দেন। তবে এ কর্মসূচিতে না গিয়ে সোমবার বিকালে সংবাদ সম্মেলনে তিন ঘণ্টা বহির্বিভাগ খোলা ও অন্যান্য চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসকরা আন্দোলন-কর্মসূচি পালনের কথা জানিয়েছেন তিনি।

বিভিন্ন স্থানে ভোগান্তি : ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য-

গোপালগঞ্জ : কমপ্লিট শাটডাউনের অংশ হিসেবে গোপালগঞ্জের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বহির্বিভাগ সেবা বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া ওয়ার্ডে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান বন্ধ রাখেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। এ অবস্থায় অনেকে ডাক্তার দেখাতে ছোটেন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে।

বরিশাল : কমপ্লিট শাট ডাউন কর্মসূচি পালন করেছেন বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এক ঘণ্টা পর চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হলেও হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা প্রদান বন্ধ ছিল। হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, সবাই কেন্দ্রীয় নির্দেশনার দিকেই তাকিয়ে আছেন। চিকিৎসকদের নিরাপত্তার স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত আসবে সেটি বাস্তবায়ন করবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে মানবিক কারণে জরুরি সেবাসহ কয়েকটি বিভাগের চিকিৎসাসেবা চালু রেখেছি।

কুমিল্লা : চিকিৎসকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিতে হয়েছে। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণ ও ময়নামতি মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে এ কর্মসূচি পালিত হয়। ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম-এনডিএফ আয়োজিত কর্মসূচি চলাকালে বক্তব্য রাখেন এনডিএফের কুমিল্লা জেলা সভাপতি ডা. মজিবুর রহমান, ডা. জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর, ডা. মো. জুয়েল রানা, ডা. মো. মাছুম হাসান, ডা. মিনহাজুল রহমান তারেক, ডা. সফিকুর রহমান প্রমুখ।

সর্বশেষ খবর