বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

টার্গেট অস্ত্র মাদকের গডফাদার

যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান শুরু

নিজস্ব প্রতিবেদক

শুরু হয়েছে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান। সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে গত রাত ১২টার পর থেকে রাজধানীসহ দেশব্যাপী এ অভিযান শুরু হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি সামনে রাখা হলেও মূল টার্গেটে রয়েছে মাদক ব্যবসায়ীসহ সমাজের চিহ্নিত অপরাধীরা। অন্যদিকে, বিশেষ অভিযানের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রস্তুত রাখা হয়েছে দেশের ৬৭টি কারাগার। শেরপুর জেলা কারাগারটি গতকাল পর্যন্ত উপযোগী না হওয়ায় ওই জেলার হাজতি-কয়েদিদের জন্য ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় এবং জামালপুর জেলা কারাগার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

বিশেষ অভিযান নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, যৌথবাহিনীর অপারেশন একই সঙ্গে মাদক নিয়ন্ত্রণে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত গডফাদারদের ধরা হবে। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে শৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির প্রথম সভা শেষে এসব কথা বলেন তিনি।

সভা শেষে উপদেষ্টা আরও বলেন, সভাটি ছিল আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভা। এ সভায় প্রধানত দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কথা হয়েছে। কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করা যায় সেসব নিয়ে কথা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা কিছু কিছু পদক্ষেপ নেব। সব বৈধ এবং অবৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল মঙ্গলবার। মধ্যরাত থেকে আমাদের যৌথবাহিনীর অপারেশন শুরু হবে হাতিয়ার (অস্ত্র) কালেকশনের জন্য। আমরা যেন অবৈধ অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করতে পারি। আমি এ ব্যাপারে আপনাদের সহযোগিতা চাই।

এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, মাদক আমাদের বড় সমস্যা। আমরা কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ আমাদের জন্য খুবই জরুরি। আমরা কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। মাদকের গডফাদারদের আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছি। মিয়ানমারের সীমান্ত নিয়ে যে সমস্যা সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছি সেটা অনগ্রাউন্ড দেখতে পাবেন।

জানা গেছে, সমাজের স্বাভাবিক অবস্থার অবনতি ঘটাতে পারে এমন ব্যক্তিদের রেখে ইতোমধ্যেই প্রস্তুত হয়েছে তালিকা। ৫ হাজার ব্যক্তিকে নিয়ে এরই মধ্যে একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে সরকারের একটি সংস্থা। তবে পরিস্থিতি এবং অবস্থা বিবেচনা করে তালিকায় আরও সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। গতকাল মঙ্গলবারই শেষ হয়েছে সব ধরনের অস্ত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা। গত ১৫ বছরে বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করেছে সরকার। গত ২৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র জমা না করলে তা অবৈধ অস্ত্র হিসেবে গণ্য হবে। তা ছাড়া, কোনো ব্যক্তির কাছে পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকলে তা জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায় পুলিশ সদর দপ্তর। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়।

যেভাবে চলবে অভিযান : গত রবিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক-৪ শাখার উপসচিব মো. আরিফ উজ জামান স্বাক্ষরিত একটি আদেশে বলা হয়েছে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা অভিযানের সমন্বয় করবেন। আজ থেকে পুলিশ সুপার, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি এবং গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্যান্য সদস্যদের সমন্বয়ে কোর কমিটির সভা করবেন। সভায় স্থগিতকৃত লাইসেন্সের তালিকা পর্যালোচনা করবেন। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার সমন্বয়ে যৌথ অপারেশন টিম গঠন করে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। চিঠিটির আরেকটি অংশে বলা হয়েছে, মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশ কমিশনাররা সংশ্লিষ্ট সব বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় আগামী ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য যৌথ অভিযান পরিচালনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রণীত স্থগিতকৃত লাইসেন্সধারীদের তালিকা এবং নির্ধারিত তারিখ পর্যন্ত জমাকৃত অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের তালিকা ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সরবারাহ করবেন।

এরই মধ্যে এই চিঠি পুলিশ মহাপরিদর্শক, সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, বিভাগীয় কমিশনার, সব জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা পুলিশ সুপারসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের পাঠানো হয়েছে।

ডিএমপির সমন্বয় সভা : পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রসহ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তরে এক সমন্বয় সভা হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসানের সভাপতিত্বে সভায় ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), এলিট ফোর্স র‌্যাব ও বাংলাদেশ আনসারের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ঢাকা মহানগরীতে অভিযান চালানোর সময় উপস্থিত থাকবেন ডিএমপি কমিশনার। সব বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় কমিশনার এ অভিযান পরিচালনা করবেন।

যা বলছে পুলিশ সদর দপ্তর : পুলিশ সদরদপ্তর সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত থানা থেকে লুট হওয়া বিভিন্ন ধরনের ৩ হাজার ৮৮০টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গোলাবারুদের মধ্যে ২ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৩ রাউন্ড গুলি, ২২ হাজার ২০১টি টিয়ার গ্যাসের সেল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া লুণ্ঠিত ২ হাজার ১৩৯টি সাউন্ড গ্রেনেডও উদ্ধার হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বলছে, শুধু রাজধানীর বিভিন্ন থানা থেকে ১ হাজার ৮৯৮টি অস্ত্র লুট করা হয়। এর মধ্যে গত ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ৪৫৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৪৪৫টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। প্রতিবাদের নামে প্রতিষ্ঠান ঘেরাও, জোর করে পদত্যাগ, ভাঙচুর, চাঁদাবাজিসহ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারীকে চিহ্নিত করে অচিরেই অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও প্রাণহানি ঘটে। শেষ তিন দিন থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের বেশকিছু স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। অনেক জায়গায় অস্ত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ও নথি লুট হয়। গত ১ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের ঘোষণা দেন।

 তবে, থানাগুলো থেকে কী পরিমাণ অস্ত্র লুট হয়েছে তা গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত জানানো হয়নি। সে বিষয়ে পরিসংখ্যান পরে জানানো হবে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সর্বশেষ খবর