শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার - রুহুল কবির রিজভী

বিএনপির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

বিএনপির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ দেশের প্রতিটি সেক্টর ধ্বংস করে দিয়েছে। এ অবস্থায় আগামীতে জনগণের ভোটে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে বিএনপিকে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তিনি বলেন, কালকেই নির্বাচন দিতে হবে এমনটি নয়, আবার অতিবিলম্বও নয়। একটা যৌক্তিক সময়ের মধ্যে বর্তমান সরকারকে আগামী জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি বিএনপির আগামী দিনের পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। রিজভী আহমেদ বলেন, ‘জুলাই বিপ্লব’ পৃথিবীর সব স্বৈরশাসকের জন্য সতর্কবার্তা। তিনি বলেন, অপরাধী যত ক্ষমতাশালী হোক আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচারকরা সব ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে বিচার কাজ পরিচালনা করবেন এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা এগুলো দেখার জন্য মিডিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করবে। কে কত ক্ষমতাশালী ব্যক্তি তা বিবেচ্য নয়। যে আইনগুলো জনগণের পক্ষে নয় তা সংস্কার করতে হবে। রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে মাফিয়াতন্ত্র দূর করতে হবে। যারাই ক্ষমতায় আসবে তাদের এ কাজগুলো করতে হবে। বিএনপির এ মুখপাত্র বলেন, দলের পক্ষ থেকে ভিশন ২০৩০ দেওয়া হেেয়ছে। ক্ষমতায় এলে কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা হবে তার রূপরেখা এই ভিশনে রয়েছে। তিনি বলেন, ক্ষমতায় এলে পারলে সেই আলোকেই অবাধ স্থিতিশীল এবং শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করা হবে। আওয়ামী লীগের শাসনামল প্রসঙ্গে রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগের কথা আর কাজের কোনো মিল নেই। তারা জনগণের ওপর দুঃশাসন চাপিয়ে দিয়েছিল। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেরা লুটপাট করেছে। জিনিসপত্রের দাম কমানোর কথা বলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ফায়দা লোটে। তারা ক্ষমতায় এসেই যত ধরনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা আছে, সব কায়েম করেছিল। দেশে মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি এটাই ছিল তাদের শাসনের নমুনা। ’৭৫ সালে আমরা দেখেছি দেশে দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ রাস্তাঘাটে মানুষের বাড়ির বারান্দায় লাশ। গত অবৈধ শাসনামলে দুর্ভিক্ষ না হলেও কাছাকাছি চলে গিয়েছিল দেশ। যেখানে আশপাশের দেশগুলোর মুদ্রাস্ফীতি ছিল সাড়ে তিন শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশ সেখানে ডবল ডিজিটে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে গেছে। লুটপাটের জন্য মেগা প্রজেক্ট করে বিদেশে টাকা পাচার করেছে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, চিরকাল ক্ষমতায় থাকার বাসনায় স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার এসব অপকর্ম করেছে। তারা নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। রিজভী আহমেদ বলেন, কর্তৃত্ববাদী শাসন আওয়ামী লীগের মজ্জাগত, তাদের রক্তের মধ্যে মিশে গেছে। ১৬ বছর শাসনে তারা দেশকে একটা উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত করেছিল। আজীবন ক্ষমতায় থাকার বাসনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিএনপিসহ তৎকালীন বিরোধী দলগুলোর অনেক মানুষের জীবন নিয়েছে। আমাদের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গুম করেছে। আয়নাঘরের মতো নির্যাতনের বিষয় উঠে আসছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করার জন্য নেতা-কর্মীদের দ্বিধাহীনভাবে নির্বিঘ্নে হত্যাকান্ড চালিয়েছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন প্রসঙ্গে রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, জুলাইয়ের হত্যাকান্ড বিশ্বে গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হবে। ইতিহাসে এটি কালো অধ্যায় হিসেবে থাকবে। তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় দেশের সংগ্রামী মানুষ এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। এ জাতির অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আদর্শগতভাবে জেগে উঠে অকাতরে নিজের জীবন দিয়ে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এবারও দেখলাম শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সিরা রাস্তায় নেমেছে। স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের বাবা-মা ও রাস্তায় ছিলেন। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে আওয়ামী দুঃশাসনের বিদায় ‘জুলাই বিপ্লব’ পৃথিবীর স্বৈরাচার একনায়কদের বিরুদ্ধে একটা সতর্কবার্তা। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আর কেউ জনগণের ইচ্ছা বা সম্মতি ছাড়া ক্ষমতায় আসতে বা থাকতে পারবে না এমন একটি বার্তা গেছে। রুহুল কবির রিজভী আহমেদ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার তাদের সাজানো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে অপরাধ করেছে। তাদের দলীয় লোকেরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করেনি। জুলাইয়ের নারকীয় হত্যাকান্ডসহ এর আগে বিগত ১৬ বছর বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক কর্মকান্ডে যেভাবে বাধা, নির্যাতন, গুম ও হত্যাকান্ড চালিয়েছে সেসবের বিচার নিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে আগামীতে যেন কেউ অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী- জানতে চাইলে রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের কথা বলছেন। তিনি বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান শুধু স্বাধীন ঘোষণা করলেই হবে না। যারা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করবেন তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সব প্রকার চাপ উপেক্ষা করে অর্পিত দায়িত্ব পালন করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে এমন মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। যারা সত্যিকার অর্থে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করবেন। নির্বাহী বিভাগের রক্ত-চক্ষুকে উপেক্ষা করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় আইন সংস্কার করা দরকার। আর সেটা করতে হবে। রিজভী আহমেদ বলেন, আমরা ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাই। তাহলেই গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাই। তাহলেই গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী হবে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিএনপির প্রত্যাশা কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার জনগণের সম্মতির সরকার। এই সরকারের প্রধান প্রধান কাজ হচ্ছে, অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করা। সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচনের দিকে  দেশকে এগিয়ে নেওয়া। তিনি বলেন, কবে নির্বাচন দেবে- এটা নিয়ে বর্তমান সরকারকে তারিখ বা বার উল্লেখ্য করে সময় বেঁধে দিতে চাই না। তবে একটা যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। অতিবিলম্ব হবে না, আবার কালকেই নির্বাচন করতে হবে এমনটাও নয়। অবশ্য মনে রাখতে হবে, অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘদিন থাকলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন গুণী মানুষ, বিশ্বনন্দিত মানুষ। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। যা কিছু দেশের জন্য ভালো ও মঙ্গলজনক, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য যা করার দরকার আমাদের বিশ্বাস এই সরকার সেসব করবে।

বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা দলীয় নেতা-কর্মীদের বিশেষ সতর্কবার্তার কথা বলছেন, এটি কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশে একটি বিপ্লব হয়েছে। বিএনপি ও অঙ্গসংঠনের অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দখল চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ আসছে। তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অভিযুক্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতার পদ-পদবি স্থগিত করা হয়েছে। নানান অভিযোগে ছাত্রদল যুবদল স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, তবে আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্তও হচ্ছে। যুবলীগ নেতা যুবদলের নাম ভাঙিয়ে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর কাছে অসংখ্য অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। নানাদিক থেকে ষড়যন্ত্র হতেই পারে। এজন্য দলের পক্ষ থেকে সতর্ক থাকার কথা বলা হচ্ছে। ষড়যন্ত্রের নানা আলামত আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা কেমন, কবে তিনি বিদেশ যাবেন? জানতে চাইলে রিজভী আহমেদ বলেন, শারীরিকভাবে উনি অনেক অসুস্থ। দীর্ঘজার্নি করার মতো অবস্থা যখন হবে চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী বিদেশ চিকিৎসার জন্য যাবেন। ভিসা সংক্রান্ত কোনো জটিলতা আছে কি না জানতে চাইলে বলেন, আশা করি নেই। সবদিক থেকে তিনি এখন মুক্ত। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন জানতে চাইলে রিজভী আহমেদ বলেন, উনার নিশ্চয় একটা পরিকল্পনা আছে। দেশে ফিরতে তার কোনো বাধা নেই।

ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে রিজভী আহমেদ বলেন, উনি অনেক অপকর্ম করেছেন। কর্মগুলো ছিল পৈশাচিক গণশত্রুর মতো। যদি ভালো কাজ করতেন তাহলে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যেতেন না। অন্যায় না করলে তিনি নিশ্চয় বিচারের মুখোমুখি হতেন। সাবেক এই স্বৈরাচার এত অন্যায় করেছেন যে, গোটা দেশ চায় বিচারের মাধ্যমে তাকে শাস্তি দেওয়া হোক। অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য শেখ হাসিনা দেশের মানুষদের হত্যা ও গুম করেছেন। যতই রাজনৈতিক মত-পার্থক্য থাকুক এভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা, এই গণহত্যা মেনে নেওয়া যায় না। বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের কথিত টানাপোড়েন নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, সমমনা সব দলের সঙ্গেই বিএনপির চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। গণতন্ত্রমনা দলগুলো স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের লক্ষ্যে একসঙ্গে রাজপথে ছিলাম। বৃহত্তর অর্থে আমাদের সঙ্গে কারও কোনো মতপার্থক্য নেই। জামায়াতে ইসলামী নিয়ে বিএনপির কোনো কোনো নেতার বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, প্রত্যেকের সতর্কভাবে কথা বলা উচিত। কাউকে তাচ্ছিল্য করা সমীচীন নয়। বিগত আন্দোলনের সময় যে দলগুলো বিএনপির পাশে ছিল তাদের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে রিজভী আহমেদ বলেন, আগামী নির্বাচনের আগে সামগ্রিক বিষয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই বলা কঠিন। সমমনা দলগুলো অনেক কাজ করেছে। আন্দোলনে তারাও হামলা-মামলার শিকার হয়েছে। অনেকের জীবন গেছে। বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে সমঝোতা থাকবে। আমাদেরই সবকিছু পেতে হবে, তা নয়।

সর্বশেষ খবর