বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা
ফেরালে গতিশীল হবে অর্থনীতি

পাচার অর্থ ফেরতের চ্যালেঞ্জ

♦ প্রক্রিয়া শুরু, গঠিত হচ্ছে বিশেষ টাস্কফোর্স ♦ সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি করছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ♦ আর্থিক খাত সংস্কারের ফলে কঠোর শাস্তির আওতায় আসবেন পাচারকারীরা ♦ বিগত সময়ে অন্তত ১৭ লাখ কোটি টাকা পাচার ♦ বেশি পাচার আমদানি রপ্তানির আড়ালে

মানিক মুনতাসির

বিপর্যস্ত হয়ে পড়া দেশের অর্থনীতি সচল করতে বিভিন্ন সময় পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। এজন্য একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হচ্ছে। আমেরিকা-ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় চিঠিও দেওয়া হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ কাজের জন্য বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারকে সহায়তার আশ্বাসও দিয়েছে। ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)-এর দুই কর্মকর্তার সঙ্গে ইতোমধ্যে এ বিষয়ে বৈঠক করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন সময় পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার এটাই মোক্ষম সময়। তাঁরা এজন্য সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।

অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আর্থিক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে কঠোর শাস্তির আওতায় আসবেন পাচারকারীরা। পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিায়াল ইন্ট্রিগিটি (জিএফআই)-এর হিসাবে বিগত ১৫ বছরে অন্তত ১৭ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটির তথ্যমতে, ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এতে বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচার করা টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি (প্রতি ডলার ১১৮ টাকা ধরে)। এ হিসেবে গড়ে প্রতি বছর পাচার করা হয়েছে অন্তত ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে, তার সুফল পেতে হলে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনতে হবে। অন্যথায় এর সুফল পাওয়া যাবে না। তবে এ প্রক্রিয়া বেশ চ্যালেঞ্জেরও। অর্থ পাচারকারীদের সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করার দাবি তোলা হয়েছে সব মহলের পক্ষ থেকে। সরকার মনে করে অর্থ পাচারের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে ডলার সংকট। যা তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে। অবশ্য নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দেড় দশক ধরেই ভঙ্গুর অর্থনীতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ নানাবিধ টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। যার অন্যতম কারণ অর্থ পাচার। বৈশ্বিক বাণিজ্যভিত্তিক কারসাজি, হুন্ডি, চোরাচালানসহ নানা পন্থায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে ১৭ লক্ষাধিক কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পাচারের অর্থ ফিরিয়ে এনে আমরা দেশের অর্থনীতিতে মেলাতে চাই। এতে অর্থনীতি গতিশীল করা অত্যন্ত সহজ হবে।’

তবে অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র জানান, শুরুতেই এতগুলো টাকা ফেরত আনা কঠিন হবে। আবার অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে সময়ও কম। এজন্য তাড়াহুড়ো না করে গঠিত টাস্কফোর্সের নেতৃত্বে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। যা খুবই দ্রুততম সময়ের মধ্যে করা হবে। এরপর সে অনুযায়ী ধাপে ধাপে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দেশ ও দেশের সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা হবে। এজন্য প্রথম পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, কানাডাসহ কয়েকটি দেশ বেছে নেওয়া হবে।

অর্থ বিভাগ বলছে, এ অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন হলে জিএফআইয়ের সহায়তাও চাইবে বাংলাদেশ। সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের তথ্য চেয়ে সে দেশের সরকারের সহায়তা চাওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক ইমেজও কাজে লাগানো হচ্ছে। কেননা বিশ্বব্যাপী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

এদিকে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটির কর্মপরিধির মধ্যে পাচারের অর্থ ফেরানোর বিষয়টিও রয়েছে। একই সঙ্গে পাচারের অর্থ ফেরাতে একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে। এ টাস্কফোর্সে অর্থ উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্টদের যুক্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে পাচার রোধে এবং আর্থিক খাতের সরকারের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঠেকাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকেও বিলুপ্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে। পাচারের সঠিক পরিসংখ্যান পেতে ও পাচারের অর্থ ফেরত আনতে করণীয় নির্ধারণে কাজ শুরু করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, পাচারের অর্থ ফেরত আনতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে। আমরা পাচারের অর্থ ফেরত আনতে সব রকম ব্যবস্থাই গ্রহণ করব। এ অর্থ ফেরত এনে দেশের অর্থনীতির মূল স্রোতে কাজে লাগানো হবে বলে জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। এটা তো পরিস্কার। আর পাচারের টাকা ফেরত আনতে হলে এ সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক কোনো সরকারের পক্ষে এ কাজ করাটা সহজ নয়। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে এ কাজ অনেকটা সহজেই করতে পারবে বলে তিনি মনে করেন।

জিএফআইয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বা সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে। পাচার ঠেকাতে এ পথে বসানো হবে বিশেষ নিরাপত্তা কৌশল। দুর্নীতিবাজদের পাকড়াও ও পাচার অর্থ ফিরিয়ে আনতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতদিন অকার্যকর থাকলেও এখন বসে নেই দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের একমাত্র সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুর্নীতি অনুসন্ধানে নড়েচড়ে বসেছে নখদন্তহীন সংস্থা খ্যাত দুদক। এদিকে গত পরশু দুদকে বৈঠকও করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)-এর দুজন প্রতিনিধি। তাঁদের কাছে পাচারের টাকা ফেরাতে সহায়তা চেয়েছে দুদক। প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহায়তার আশ্বাসও দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এর আগে ৩০ আগস্ট যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও বৈদেশিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রীর উদ্দেশে বাংলাদেশিদের অবৈধ সম্পদ ফ্রিজ ও দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল টিআইবি ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক চারটি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা। এ ছাড়া সুইজারল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ-সম্পদ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল টিআইবি। গতকাল ‘লুটেরাদের বিরুদ্ধে আমরা’ ব্যানারে একটি সংগঠন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। সমাবেশ শেষে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে একটি স্মারকলিপিও দিয়েছে।

পুনরুদ্ধারে সহযোগিতায় আগ্রহ ইউএনওডিসির

তদন্তে ৩৩ গার্মেন্টের ৮২১ কোটি টাকা পাচার

 

সর্বশেষ খবর