রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

মূল্য শুল্কায়নে সরকারি বেসরকারি খাতে একই ট্যারিফের দাবি

জিন্নাতুন নূর

মূল্য শুল্কায়নে সরকারি বেসরকারি খাতে একই ট্যারিফের দাবি

অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারি ও বেসরকারি খাতে মূল্য শুল্কায়নে সরকারের দ্বৈতনীতির কারণে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন বেসরকারি আমদানিকারকরা। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে একই নীতিতে মূল্য শুল্কায়নের দাবি জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেন, এক দেশে একই পণ্যের ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি থাকা ঠিক নয়। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দ্রুত এই দ্বৈতনীতি পরিবর্তন করে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল  আমদানির ক্ষেত্রে অভিন্ন নীতি বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাতে মূল্য শুল্কায়ন একই পদ্ধতিতে হতে হবে। হয় তা ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে প্রাইসিং ফর্মুলা নির্ধারণ করতে হবে, না হয় ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে প্রাইসিং ফর্মুলা নির্ধারণ করতে হবে। এদিকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে মূল্য শুল্কায়নে এক নীতি বাস্তবায়ন করা যায় কি না সে লক্ষ্যে বেসরকারি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারদের অনুরোধে অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই কমিটির মূল্যায়ন ও সুপারিশের ভিত্তিতেই পরবর্তীতে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা করণীয় নির্ধারণে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সঙ্গে আলোচনায় বসবে। পরবর্তীতে আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রাথমিক আলোচনায় এই কমিটিতে কারা থাকবেন সেই বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেলের মূল্য শুল্কায়নে একই নীতি বাস্তবায়নের বিষয়টি এখনই নির্ধারিত হবে নাকি পরের বাজেটের জন্য অপেক্ষা করা হবে- এ রকম অনেক টেকনিক্যাল বিষয়ও আছে। বিষয়গুলো নিয়ে আগে এনবিআর বসবে, তারপর এ নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস খালাস করার সময় ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্কায়ন করে। অন্যদিকে একই এইচএস কোডে যখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানি করে তাদের শুল্কায়ন করা হয় ইনভয়েস ভ্যালুতে। এর সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পণ্য খালাসের অনুমতি দেয় কাস্টমস হাউস। পণ্যের ইনভয়েস ভ্যালুর ক্ষেত্রে পণ্যের ওপর আরেপিত কাস্টমস ডিউটি সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে বিপিসি। এর ফলে এনবিআর পরবর্তী সময়ে বিপিসিকে অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধের জন্য ডিমান্ড নোট করে থাকে। যা বিপিসি তার প্রাইসিং ফর্মুলায় অন্তর্ভুক্ত রাখে না। এখানে সরকারের সঙ্গে এনবিআরের দ্বৈতনীতি পরিলক্ষিত হয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সার্বিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে অবশ্যই সরকারকে মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈত নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের জন্য একই নীতিতে মূল্য শুল্কায়ন করতে হবে। তাহলেই অর্থসংকট কেটে যাবে এবং জ্বালানি তেল পাচার রোধ করাও সম্ভব হবে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু একই পণ্য সেক্ষেত্রে একই ধরনের শুল্ক হওয়া উচিত। এতে সরকারেরও সুবিধা হয়। একই পণ্যে শুল্কের পার্থক্য হলে এখন আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সঙ্গে যে সমন্বয় হচ্ছে সেক্ষেত্রে অসুবিধা হয়। একই পণ্য একই কোডে একই ধরনের শুল্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। তিনি আরও বলেন, এখন যেহেতু বাজারমূল্যের ফর্মুলা অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম ওঠা-নামা করবে সুতরাং তাদেরও (অন্তর্বর্তী সরকার) হিসাব করতে সুবিধা হবে যদি একই ধরনের শুল্কায়ন করা হয়। এই খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈতনীতির কারণে বেসরকারি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারকদের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়তি ভ্যাট-ট্যাক্সও পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিপিসি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ন করে যে পরিমাণ শুল্ক দিচ্ছে, বেসরকারি পর্যায়ে তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। ফলে তারা ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। তাই সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এক দেশে একই পণ্যের সরকারি ও বেসরকারি শুল্ক মূল্যায়ন পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে না। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘এক দেশে একই পণ্যের ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতি থাকা ঠিক নয়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার কোন চিন্তা-ভাবনা থেকে এমন নীতি করেছে এটি ভালো করে দেখা দরকার।’ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এরই মধ্যে তিন-চারটি বেসরকারি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান একই নীতিতে মূল্য শুল্কায়নের বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেছিল। বিষয়টি নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য এবং এটি এক্সামিন করার জন্য আমি একটি কমিটি গঠন করে দিতে যাচ্ছি। এই কমিটি থেকে যে সুপারিশ আসবে তার ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে একটি জিনিস হচ্ছে ট্যারিফ ভ্যালু আর আরেকটি জিনিস হচ্ছে ইনভয়েস ভ্যালু। আইএমএফ আমাদের ওপর  ইনভয়েস ভ্যালুতে যেতে পীড়াপীড়ি করছে। কিন্তু ইনভয়েস ভ্যালুতে গেলে জ্বালানির মূল্য হঠাৎ করে উঠে যেতে পারে।’ বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ চলতি বছরের মার্চ থেকে শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। সে হিসেবে প্রতি মাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে সেপ্টেম্বরের জন্য জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করেছে সরকার। এতে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৫ টাকা ৫০ পয়সা, অকটেন ১২৫ টাকায় ও পেট্রলের ১২১ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭২ লাখ মেট্রিক টন। মোট চাহিদার প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন ডিজেলই ব্যবহার হয়। বাকিটুকু চাহিদা পূরণ হয় পেট্রল, অকটেন, কেরোসিন, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েলসহ বিভিন্ন জ্বালানি তেলে।

সর্বশেষ খবর