বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

শ্রমিকদের ১৮ দাবি মেনে নিল মালিকপক্ষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে আয়োজিত বৈঠকে শ্রমিকদের ১৮ দাবি মেনে নিয়েছে মালিকপক্ষ। এ পরিস্থিতিতে আজ বুধবার থেকেই সারা দেশের সব শিল্পকারখানা খোলা রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গতকাল শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে শ্রমিক এবং মালিক পক্ষের বৈঠক শেষে বিজিএমইএ ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা এ বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দেন। ঘোষণা পড়ে শোনান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, বৈঠকে শ্রমিক পক্ষের ৩৫ জন প্রতিনিধি ছিলেন, মালিক পক্ষও ছিলেন। তাদের ১৮টি দাবির বিষয়ে একমত পোষণ করেছি। বুধবার (আজ) থেকে সব কারখানা নির্বিঘ্নে চলবে। এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.), শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার উপস্থিত ছিলেন। এর আগে মালিক ও শ্রমিক পক্ষ নিয়ে বৈঠক করেন চার উপদেষ্টা। দীর্ঘ বৈঠক শেষে এই সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বুধবার (আজ) থেকে সব পোশাক কারখানা সচল থাকবে বলে জানান। এর আগে গতকাল সকালে সাভারের আশুলিয়ায় হা-মীম গ্রুপ, শারমীন গ্রুপ, এনভয়, নাসা গ্রুপ, স্টারলিংসহ ৪৬টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া নয়টি কারখানায় শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়ে কর্মবিরতি পালন করায় ‘বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায়’ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। অপরদিকে গাজীপুরে বেশির ভাগ পোশাক তৈরি কারখানায় গতকাল চলেছে উৎপাদন। তবে শ্রমিক আন্দোলনের মুখে সোমবার বন্ধ ঘোষণা করা ১৩টি কারখানার মধ্যে ১১টি মঙ্গলবারও বন্ধ ছিল। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে শ্রমিক এবং মালিক পক্ষের বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, দেশে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের ১৮ দাবি মেনে নিয়েছেন মালিক পক্ষ। সব পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বিদ্যমান হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ছে। সেই সঙ্গে অক্টোবরের মধ্যে সব কারখানায় সরকার ঘোষিত নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া ১০ অক্টোবরের মধ্যে কারখানা কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকদের সব বকেয়া মজুরি পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া টিফিন বিল প্রদান, শ্রমঘন এলাকায় টিসিবি ও ওএমএসের মাধ্যমে রেশন প্রদান, ঝুট ব্যবসা মনিটরিং করে শ্রমিকদের মধ্য থেকে ক্রেতা বের করা, কারখানার শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করা বন্ধ করতে মনিটরিং বিষয়ে একমত হয়েছে উভয়পক্ষ। গত বছর ন্যূনতম মজুরি আন্দোলন ও বিভিন্ন সময়ে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য রিভিউ করে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সমাধান করা, নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা, জুলাই আন্দোলনে শহীদদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা, রানাপ্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনসের বিষয়ে কমিটি গঠন, সব কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার নিশ্চিতের দাবি মানা হয়েছে। অন্যায্যভাবে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করা, নারী কর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২০ দিন, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে তিন সদস্যের কমিটি গঠন, শ্রম আইন সংশোধন নিয়ে কাজ করা, প্রভিডেন্ট ফান্ড পর্যালোচলা করে শ্রমিক মালিকের আলোচনার মাধ্যমে চালু করা এবং প্রতি বছর দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট দিতে কমিটি গঠন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে সোমবার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সরকারের কাছে ১৮টি দাবি উত্থাপন করে শ্রমিক পক্ষ।

আশুলিয়ায় ৫৫ পোশাক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ, গ্রেপ্তার ৮ : সাভার প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকাল থেকে আশুলিয়ার ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুই পাশের বেশির ভাগ কারখানায় অনির্দিষ্টকালের বন্ধের নোটিস লাগানো হয়। কারখানাগুলোর সামনে অবস্থান নেন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে ৪৬টি কারখানা শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ এবং নয়টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় বলে জানান আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম। এ ছাড়া ওই এলাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ‘অস্থিতিশীল পরিবেশ’ সৃষ্টির অভিযোগে আটজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শিল্প পুলিশ জানায়, ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা, বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধসহ বিভিন্ন দাবিতে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের বেশ কিছু কারখানায় গত রবিবার থেকে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এরই জেরে মহাসড়কের উভয়পাশে অবস্থিত অর্ধশত কারখানা বন্ধসহ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। গতকালও ওই এলাকার হা-মীম গ্রুপ, শারমীন গ্রুপ, এনভয়, নাসা গ্রুপ, স্টারলিংসহ ৪৬টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া নয়টি কারখানায় শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়ে কর্মবিরতি পালন করায় ‘বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায়’ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। তবে ডিইপিজেডসহ বাকি কারখানাগুলোতে উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে জানিয়ে আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেছেন, এই অঞ্চলের ম্যাক্সিমাম ফ্যাক্টরি খোলা। এখানে ৭৭৫টি তৈরি পোশাক কারখানা আছে। ৫৫টি কারখানা বন্ধ থাকলেও সকাল থেকে কোথাও অপ্রীতিকর কোনো ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে মোতায়েন রয়েছে। আশুলিয়ার বিভিন্ন স্থানে গার্মেন্ট সেক্টরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তারের কথা জানান আশুলিয়া থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক। গ্রেপ্তারা হলেন- আশুলিয়ার সুবন্ধী এলাকার দেওয়ান আবদুল হাই (৫২), দক্ষিণ গাজীরচট এলাকার শুক্কুর আলী (৪০), আশুলিয়ার জাহিদুল ইসলাম (২৪), টাঙ্গাইল জেলার রনি (২৭), একই জেলার রাব্বি মিয়া (২৫), চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মিজানুর রহমান (৩৮), একই জেলার জাহিদুল (৩৮) ও কুমিল্লা জেলার শাহাপরান (৩৩)। ওসি আবু বকর বলেন, গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়া শেষে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত বাকিদের গ্রেপ্তারেও অভিযান চলছে।

গাজীপুরে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ চলছে বেশির ভাগ পোশাক কারখানায় : গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরে বেশির ভাগ পোশাক তৈরি কারখানায় গতকাল চলেছে উৎপাদন। তবে শ্রমিক আন্দোলনের মুখে সোমবার বন্ধ ঘোষণা করা ১৩টি কারখানার মধ্যে ১১টি মঙ্গলবারও বন্ধ ছিল। সোমবার গাজীপুরের টঙ্গী, বাঘেরবাজার ও মৌচাক এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলেও মঙ্গলবার কোথাও শ্রমিক বিক্ষোভের সংবাদ পাওয়া যায়নি। মঙ্গলবার সকালে যথারীতি শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগ দিয়েছেন শ্রমিকরা। কারখানা এলাকায় নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন ছাড়াও রয়েছে সেনাবাহিনী ও বিজিবির টহল। সকাল থেকে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর খবর পাওয়া যায়নি। শিল্প মালিক, শ্রমিক সূত্রে জানা গেছে, টানা কয়েকদিন শ্রমিক অসন্তোষ চলছে গাজীপুরে। সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, কারখানা ভাঙচুরের ঘটনায় অশান্ত হয়ে পড়ে গাজীপুর শিল্পাঞ্চল। ছুটি ঘোষণা করা হয় ১৩টি কারখানায়। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে মঙ্গলবার সকাল থেকে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে বেশির ভাগ কারখানা খোলা ছিল। শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগ দিয়েছে নারী-পুরুষ শ্রমিকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। কারখানা নিরাপত্তায় নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী ছাড়াও অতিরিক্ত পুলিশ কাজ করেছে। এ ছাড়া বিজিবি ও সেনাবাহিনীর টহল জোরদার করা হয়। এদিকে, কারখানায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি ও শ্রমিকদের উসকে দেওয়ার অভিযোগে যৌথ অভিযানে গত দুই দিনে (২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর) ২৪ জনকে আটক করা হয়। এ ছাড়া ১৩টি কারখানা বন্ধ করা হয়। এর মধ্যে ৪টি শ্রম আইন অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য এবং ৯টি সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. খলিলুর রহমান বলেন, মঙ্গলবার সকাল থেকেই গাজীপুরে বেশির ভাগ কারখানা খোলা রয়েছে। বিকাল পর্যন্ত কোনো শ্রমিক অসন্তোষের খবর পাওয়া যায়নি। কারখানা নিরাপত্তায় শিল্প পুলিশের পাশাপাশি জেলা পুলিশ, মহানগর পুলিশ কাজ করছে। বিজিবি ও সেনাবাহিনী টহল জোরদার করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, মঙ্গলবার বন্ধ ঘোষণা করা ১৩টি কারখানার মধ্যে ১১টি কার্যক্রমে ফিরেনি। এর মধ্যে দুটি কারখানা মঙ্গলবার খুলেছে। বাকি ১১টি কারখানা মঙ্গলবারও বন্ধ আছে। তবে আশার কথা হলো নতুন করে কোনো কারখানা বন্ধ হয়নি।

সর্বশেষ খবর