রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা ফেরতে নতুন প্ল্যান

চীন ভারত যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমার রাশিয়াসহ ছয় দেশের সমন্বয়ে বৈঠক ডিসেম্বরে

মানিক মুনতাসির

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে একটি নতুন কর্মপরিকল্পনা করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর আওতায় রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত কিংবা তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো যায় কি না সে বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। এজন্য আগামী ডিসেম্বরে চীন, ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে নিয়ে একটি কনফারেন্স করার পরিকল্পনা করছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। স্বরাষ্ট্র ও অর্থ বিভাগসূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

তবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে যেন কোনো ধরনের অরাজকতা না দেখা দেয় সেজন্য আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জাতিসংঘের সাধারণ  অধিবেশনেও এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় খাদ্য সংকট মোকাবিলায় আগামী জুলাইয়ের মধ্যে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আরও ৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের অধিবেশনেও এ নিয়ে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এর অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সামাজিক অস্থিরতা ও মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অন্তত ৩ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আগামী মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায়ও এ সংকট সমাধানের পক্ষে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরবেন অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা এটাকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই অ্যাড্রেস করেছেন।’ তবে সময়টাকে আরও দীর্ঘায়িত না করে দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে মঙ্গলবার রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনায় তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের সতর্ক হতে হবে। এ সংকটের সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র এশিয়া অঞ্চল সমস্যায় পড়বে। তাই আমাদের অবশ্যই এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।’

ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন করে ভাবার প্রস্তাব দেন-‘প্রথমত. আমরা চাই জাতিসংঘ মহাসচিব যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সব পক্ষের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করুন। সম্মেলনে সংকটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নতুন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমাধানের উপায় কী হতে পারে, তেমন প্রস্তাব আসুক। দ্বিতীয়ত. জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ যৌথভাবে পরিচালিত “জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান” কার্যক্রমে নতুন করে প্রাণশক্তি যোগ করার প্রয়োজন। যেহেতু এখন রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় করার মতো তহবিলের অভাব রয়েছে তাই রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়া আরও জোরদার করতে হবে।’

তৃতীয় প্রস্তাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই আন্তরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’ এসব প্রস্তাবের প্রেক্ষিতেই ছয় দেশের অংশগ্রহণে ও ইউএনএইচসিআরের তত্ত্বাবধানে একটি নতুন কনফারেন্স হতে যাচ্ছে, যা হবে শুধুই রোহিঙ্গা সমাধানের জন্য। এ উদ্যোগ সফল হলে রোহিঙ্গাদের খুব সহজেই নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

অর্থ বিভাগসূত্র জানান, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চীন, ভারত, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে চায় বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা এগিয়ে নিতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিয়ষক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে জীবনের নিরাপত্তা ও নিরাপদ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা নিয়ে নিজ দেশে ফেরত যেতে চায় তারা। এজন্য কোন প্রক্রিয়ায়, কোথায়, কীভাবে প্রত্যাবাসন করা যায় তা নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, তৃতীয় কোনো দেশ বা স্থানে রোহিঙ্গা নাগরিকদের পাঠানো যায় কি না, সে বিষয়টিও ইউএনএইচসিআরকে সমীক্ষা করতে বলা হয়েছে।

সূত্র জানান, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, চীনের বাংলাদেশ এম্বাসি ও ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে একটি বৈঠকের আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ পরিকল্পনা আরও বাস্তবভিত্তিক করতে রাশিয়াকে যুক্ত করা হয়েছে। এ বৈঠকের আয়োজক হতে ইউএনএইচসিআরকে অনুরোধ করা হয়েছে। কো-আয়োজক থাকবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। নতুন এ কর্মপরিকল্পনায় রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার কৌশল নির্ধারণ করা হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত ও চীনের সর্বাত্মক সহায়তা চাওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দানকালেও এ বিষয়ে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রত্যাবাসনের আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জীবনধারণ স্বচ্ছন্দ করতে আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কেননা সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের আর্থিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। এজন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য অতিরিক্ত ৩ বিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে এ সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

প্রথম দিকে রোহিঙ্গাদের জীবনধারণের জন্য জাতিসংঘ, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসছিল। কিন্তু করোনা মহামারি, বৈশ্বিক সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণ দেখিয়ে সম্প্রতি আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা। ফলে রোহিঙ্গা নাগরিকরা নিজেদের চাহিদা মেটাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে চলে আসছেন। কাজের খোঁজে তারা চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ঢাকায় এমনকি ভুয়া পাসপোর্ট বানিয়ে দেশের বাইরেও চলে যাচ্ছেন, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সরকার।

সর্বশেষ খবর