অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতামত তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রতিনিধিরা। গতকাল বিকাল ৪টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে এ কথা জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে রোডম্যাপ দিতে বলেছি।
নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতামত তুলে ধরার কথা উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।
আগামী নির্বাচন কবে হবে, সেই রোডম্যাপ ঘোষণা করতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ভোটার আইডি কার্ড স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়ার আইন করা হয়েছিল, তা অধ্যাদেশ জারি করে বাতিলের দাবি জানিয়েছি। বিতর্কিত কোনো ব্যক্তিকে যেন নির্বাচন সংস্কারে গঠিত কমিটিতে রাখা না হয় তারও দাবি জানায় বিএনপি। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ভুয়া, বিতর্কিত ও পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সাবেক তিন নির্বাচন কমিশনের সব কমিশনারকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল।নির্বাচন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন- মাস, দিনকাল নিয়ে আমি কথা বলিনি। উনারা বলছেন নির্বাচন অনুষ্ঠান তাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি। তারা সবকিছু দেখছেন। আমাদের দাবিগুলো জনগণের, আমাদের দাবিগুলো তাদেরও। সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। নির্বাচন ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের মতামত দিয়ে এসেছি। তিনি বলেন, আমরা বলেছি নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করার মূল হোতা বিচারপতি খায়রুল হক দাবি করে ফখরুল বলেন, তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার মূল নায়ক ছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি। প্রশাসনে যারা ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হয়ে কাজ করেছে, সহায়তা করেছে, লুটপাট, অনাচার, অত্যাচার, গুম-খুনের ব্যাপারে তাদের বেশির ভাগই এখনো নিজ নিজ জায়গায় বহাল আছে। তাদের অবিলম্বে সরিয়ে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের আনার কথা বলেছি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিতর্কিত জেলা প্রশাসক কীভাবে নিয়োগ পেয়েছে তা বিএনপি জানতে চেয়েছে। একই সঙ্গে অভিযুক্তদের নিয়োগ বাতিল করতে বলেছি। যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে ফিট লিস্ট করতে বলেছি। চুক্তিভিত্তিক কিছু নিয়োগ বাতিল করতে বলেছি। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দু-একজন আছেন যারা বিপ্লবের মূল স্পিরিটকে ব্যাহত করছে। তাদের সরানোর কথা বলেছি। গত ১৫ বছরের পদোন্নতিবঞ্চিত সরকারি কর্মকর্তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিতে বিএনপি প্রস্তাব করেছে বলে জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, হাই কোর্ট বিভাগের বেশির ভাগ নিয়োগই ছিল দলীয় ভিত্তিতে। প্রায় ৩০ জন বিচারক এখনো বহাল তবিয়তে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলেছি। দলকানা বিচারকদের অপসারণ করতে বলেছি। অতিদ্রুত পিপি-জিপি নতুন করে নিয়োগ করতে বলেছি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তারদের (দুর্নীতি, হত্যা) জামিন দেওয়া হচ্ছে। এটা উদ্বেগজনক। এটা দেখতে বলেছি। ২০০৭ থেকে ৫ আগস্ট (২০২৪) পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আমলের দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা, গায়েবি, ভুয়া, রাজনৈতিক উদ্দেশে সাজানো মামলা প্রত্যাহারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষণা ও প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি। বিগত সরকারের মন্ত্রী, সাবেক আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। তারা কীভাব পালাচ্ছেন, কার সহযোগিতায় পালাচ্ছেন। তা দেখার জন্য বলেছি।
তিনি বলেন, আরেকটা বিষয় আমরা জোর দিয়ে বলেছি, পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ভারতে আছেন। সেখান থেকে তাকে কেন্দ্র করে অপপ্রচার চলছে। এ বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য এবং ওই অবস্থা থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে বলেছি। তারা ভারত সরকারকে অনুরোধ করবেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে অস্থিরতার চেষ্টা হচ্ছে। বলেছি এটা আরও গভীরভাবে দেখে, কারা এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
গুম-খুনের সঙ্গে জড়িতরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, জিয়াউল আহসান ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। অবিলম্বে সবাইকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে বলেছি এবং ব্যবস্থা নিতে বলেছি। জাতিসংঘের একটি দল এসেছে বাংলাদেশে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের সহযোগিতা করছে না সংশ্লিষ্টরা।
তিনি বলেন, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কিছু সনাতনী মানুষ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জনগণকে উসকে দিচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন হচ্ছে, অত্যাচার হচ্ছে বলে অপপ্রচার ছড়াচ্ছে। এটা মিথ্যা। এটা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এটাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি।
এর আগে বেলা আড়াইটায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে বসে বিএনপির প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্যদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও সালাউদ্দিন আহমেদ।